Homeসব খবরজেলার খবরহাওরে বিলুপ্তির পথে দেশী মাছ, বাজার দখল হাইব্রিডে

হাওরে বিলুপ্তির পথে দেশী মাছ, বাজার দখল হাইব্রিডে

সুনামগঞ্জের হাওর এক সময় মাছের রাজ্য হলেও আগের মতো এখন আর হাট-বাজারে মিলছে না। প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্তির পথে। বাজার দখল করেছে চাষযোগ্য হাইব্রিড জাতীয় মাছ। ফলে তা খেয়েই মেটাতে হচ্ছে আমিষের চাহিদা। হঠাৎ কিছু দেশী মাছ মিললেও চড়া দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় এক সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ মিঠা পানির দেশী সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেত। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ওই মাছ স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ভৈরবে রফতানি করা হতো। যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির খাতে ভূমিকা রাখত। কিন্তু এখন আর এই সব মাছ সচরাচর চোখে পড়ে না। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে অবাধে জলমহাল সেচে মৎস্য নিধন করার মূল কারণেই দেশী মাছ কমে যাচ্ছে।

নির্বিচারে পোনা মাছ ধরা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, কৃষি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বর্ষায় মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জাতের দেশী মাছের প্রজাতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর মধ্য রয়েছে রানী মাছ, গুতুম, দারকিনা, চাপিলা, চাটুয়া, চাঁন্দা, বড় চান্দা, গোল চান্দা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশী পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, শোল, কাংলা, মলা, ঢেলা, কানপোনা, রিটা, পিয়ালি, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, কাজলি, চ্যাং, ছোট চিংড়ি, বাতাশি, বড় বাইম, বাগাই, তারা বাইম, কাইক্যা ইত্যাদি। এসব মাছের জায়গা দখল করেছে হাইব্রিড পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, সিলভার, কার্গো, মিরর কার্প, ঘ্রাস কার্প, সরপুঁটি ইত্যাদি।

বিভিন্ন এলাকার মাছ বাজারে দেখা গেছে দাম-দরের অস্থিরতা। এক-দুই বছর আগেও যেখানে তেলাপিয়া ছিল মধ্যবিত্তের সাধ্যের ভেতরে, সেখানে তেলাপিয়ার দাম এখন দ্রুত গতিতে বাড়ছে। একই অবস্থা পাঙ্গাসেরও। বাজারে আকারভেদে তেলাপিয়ার কেজি দুই শ’ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছরের এমন দিনে তেলাপিয়ার কেজি ছিল ১২০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে। গরিবের মাছ হিসেবে খ্যাত পাঙ্গাশের কেজি গত বছর ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন পাঙ্গাস ১৮০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সিলভার কাপ আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে দুই শ’ টাকা কেজি দরে। এ জাতীয় মাছেই আমিষের চাহিদা মিটত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের। কিন্তু দাম বাড়ায় সেটিও এখন অনেকের কপালে জুটছে না।

বাজারে আসা ক্রেতাদের অনেকে বলেন, তেলাপিয়া-পাঙ্গাসে আমাদের স্বস্তি ছিল এক বছর আগেও। সেই জায়গাটাতেও এখন চরম অস্বস্তি। শুধু পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া বা সিলভারই নয়, অন্যান্য মাছের দামও বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি আকার ভেদে রুই-কাতলা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কৈ মাছ (বড়) বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা দরে। এছাড়া চিংড়ি মাছের মধ্যে ছোট আকারের প্রতি কেজির দাম চার শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকা। মাঝারি আকারের প্রতি কেজি তিন শ’ টাকার বেশি।

এদিকে জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সর্ববৃহৎ পাকনা হাওর ও হালির হাওর ঘুরে কয়েকজন জেলের সাথে কথা হলে বলেন, এখন আগের মতো মাছ নেই হাওর বা নদীতে। হাওরে পাতানো জাল তুলে হতাশ হতে হয় তাদের। কিছু ছোট পুঁটি, চান্দা, বাইলা, তারা বাইম পাঁচ মিশালী মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছের দেখা নেই।

জেলেরা বলেন, সারাদিন হাওরে মাছ মেরে তাদের রোজের পারিশ্রমিক অনেক দিন হয় না। আগে বর্ষার পানিতে হাওরে রুই, কাতলা, বোয়াল, কালিবাউসসহ অনেক জাতের মাছ পাওয়া যেত। এখন কিছু ইছা, ছোট পুঁটি আর চান্দার গুঁড়া কিছু পাঁচমিশালি মাছ ছাড়া তেমন কোনো মাছ মিলে না। এর মধ্যে জলমহাল (বিল) ইজারাদারদের রক্তচক্ষু ও দৌরাত্বের কারণে জেলেরা চরম হতাশ হয়ে পড়েন। ভরা বর্ষায় হাওরের বেশ জায়গা জুড়ে জলমহালের সীমানা দিয়ে তারা জেলেদের মাছ ধরার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে অনেক সময় বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লে জেলেদের ওপর অত্যাচার করে।

বেশ কিছু বাজারে দেখা গেছে, এই ভরা বর্ষা মৌসুমে পুকুরের চাষ করা পাঙ্গাশ, কই, তেলাপিয়া ছাড়া প্রাকৃতিক পানির মাছ নেই বললেই চলে। বাজার এখন চাষের মাছের দখলে। আর যে দু-একটা জাতের মাছ পাওয়া যায়, তার দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে।

জামালগঞ্জ-সাচনাবাজারসহ গ্রামীণ হাট বাজারেও এখন হাইব্রিড মাছের দখলে। বর্ষা ও হেমন্তে জলাশয়ে জেলে ও জলমহালের ইজারাদাররা মাছ ধরে এলাকার বাইরের পাইকারদের কাছে বেশি দামে বিক্রির কারণেও মাছের সিজনেও প্রায়ই দেশী মাছ পাওয়া যায় না।

জামালগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, জলমহাল সেচে মৎস্য নিধন, নির্বিচারে পোনা মাছ ধরা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে বেশ কিছু প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে এসব বন্ধ করে মাছের প্রজননের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করে এলাকাবাসী সচেতন হলে দেশী মাছ রক্ষা হতে পারে।-নয়া দিগন্ত।

Advertisement