Homeঅন্যান্যতিন লাখ তালগাছ লাগিয়েছেন চিত্তরঞ্জন

তিন লাখ তালগাছ লাগিয়েছেন চিত্তরঞ্জন

বর্ষার এক তুমুল বৃষ্টির দিন। চায়ের দোকানে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। পাশেই দেখলেন, এক ভদ্রলোক মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। চিত্তরঞ্জন নিজে পড়ালেখা না জানলেও পত্রিকায় তালগাছের ছবি দেখে কৌতূহলী হলেন।

পরে সেই ভদ্রলোক চিত্তরঞ্জনকে বললেন, ‘দেখেন আমেরিকার এক বিজ্ঞানী বলেছেন, তালগাছের অনেক গুণ। সবচেয়ে বড় কথা মাথা উঁচু এ গাছটি বজ্রপাতকে দুর্বল করে দেয়।’

তালগাছ নিয়ে বিজ্ঞানীর কথাটা খুব মনে ধরেছিল চিত্তরঞ্জনের। শুনেই মনে হয়েছিল, প্রায়ই তো আশপাশের গ্রামে ঠাডা (বজ্রপাত) পড়ে মানুষ মরে।

মাঠে-প্রান্তরে আরো তালগাছ থাকলে নিশ্চয়ই এটা হতো না। চিত্তরঞ্জনের বাবাও বৃক্ষ রোপণ করতেন। বাড়িতে তালগাছও লাগিয়েছিলেন তিনি। চিত্তরঞ্জন ঠিক করলেন, এবার বাবার রোপণ করা সেই গাছের বীজ লাগাবেন বিলের রাস্তার ধারে।

শুরু করলেন তা দিয়েই। কিন্তু একটা তালগাছ থেকে আরেকটা বীজ পাওয়া সম্ভব! ফলে মন ভরল না তাঁর। ঠিক করলেন, আশপাশের গ্রামেও ঢু মারবেন তালের বীজের খোঁজে। কিছুদিনের মধ্যে হাজারখানেক বীজ সংগ্রহ করে তা লাগিয়ে দিলেন প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ধোপাদী-মশিয়াহাটী সড়কের দুই ধারে। এভাবে প্রথম বছর প্রায় আড়াই হাজার বীজ লাগিয়েছিলেন তিনি। সে ২০০৮ সালের কথা।

তালগাছ লাগানোর ‘বাতিক’ আর ছাড়েনি চিত্তরঞ্জনকে। আজ অবধি চলছে তা। গত ১৬ বছরে তিন লাখের কাছাকাছি (দুই লাখ ৮৮ হাজার) তালের বীজ বুনেছেন যশোরের অভয়নগরের আটটি ইউনিয়ন, নওয়াপাড়া পৌর এলাকা ও মণিরামপুরের ৪২টি ছোট-বড় সড়কের দুই ধারে। ৫৬ হাজার খেজুরগাছের বীজও রোপণ করেছেন তিনি।

তালগাছপ্রেমী চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ি অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের দক্ষিণপাড়ায়। বিশেষ করে তালগাছের সুবাদে উপজেলার অনেক মানুষই ‘চিত্ত দা’ নামে একডাকে চেনে তাঁকে। বৃক্ষপ্রেমী মানুষ হলেও কৃষিকাজে জীবিকার পুরো ব্যবস্থা না হওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য চিত্তরঞ্জন মাঝেমধ্যে গাছ কিনে চেরাই করে বিক্রি করেন।

ফিরেছে বাবুই পাখিরা

২০০৮ সালে বোনা বীজগুলো বড়সড় গাছ হয়ে এরই মধ্যে উঁকি মারছে আকাশে। এই গরমে গাছের তলায় বসে মানুষ গল্প করছে। তাল পাকলে নিয়ে যাচ্ছে। বজ্রপাতের সময় ক্ষেত থেকে উঠে এসব গাছের নিচেই নিরাপত্তা খোঁজেন স্থানীয় কৃষকরা। এসব দেখে চিত্তরঞ্জনের মন ভালো লাগায় ভরে যায়। তবে আরেকটি কারণেও তালগাছ লাগিয়ে খুব তৃপ্ত তিনি। আর তা হলো বাবুই পাখিদের ফেরা। চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘তালগাছের ছায়ায় বসে মানুষ গল্প করে, কৃষকরা ভাত খায় বা বজ্রবৃষ্টির সময় আশ্রয় নেয়—এসব দেখে খুব ভালো লাগে। তবে তালগাছ ছিল না বলে এত বছর ধরে এলাকায় বাবুই পাখির খুব একটা দেখা মিলত না। এখন সে পাখিরা আবার ফিরছে। ওদের দেখে মন ভরে যায়।’

কী তাঁর অনুপ্রেরণা?

কিসের তাগিদে পথে-প্রান্তরে তালের বীজ রোপণ শুরু করেছিলেন, প্রশ্নটি শুনে একটু হাসলেন চিত্তরঞ্জন। একটু পর বললেন, ‘আমি তো গরিব মানুষ। লেখাপড়া জানি নে। গাছগুলো মানুষকে ছায়া দেয়। বজ্রপাত ঠেকায়। ফল দেয়। অক্সিজেন দেয়। যাদের টাকা আছে তারা মানুষের জন্য অনেক কিছু করে। কিন্তু গাছ লাগানো ছাড়া তো মানুষের উপকার করার অন্য উপায় জানা নাই আমার!’

নানা কারণে এ পর্যন্ত চিত্তরঞ্জনের এত কষ্টে লাগানো কয়েক হাজার গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার কারণে অনেক গাছ মারা গেছে। কিছু গাছ স্থানীয়রা নষ্ট করেছে। কিছু উপড়ে ফেলা হয়েছে রাস্তা সংস্কারের সময়। আবার প্রতিনিয়ত হাতপাখা ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট গাছের পাতা কেটে নিয়ে যায়। এভাবে অনেক চারা নষ্ট হয়েছে।

গাছের পরিচর্যাও করেন তিনি

শুধু তালের বীজ রোপণ করেই ক্ষান্ত দেন না চিত্তরঞ্জন দাস। নিয়মিত গাছগুলোর পরিচর্যাও করেন। কোমরে গামছা বেঁধে প্রায়ই সকালে বিভিন্ন গ্রামের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন সাইকেলে। সঙ্গে থাকে কোদাল, পানির বোতল ও দা। চারার নিচে আগাছা হলে তুলে ফেলেন। বৃষ্টিতে গোড়া থেকে মাটি সরে গেলে জমি থেকে মাটি নিয়ে তা ভরে দেন। গাছ বাঁচানোর কাজে স্থানীয়দেরও যুক্ত করার চেষ্টা করেন।

নিজের পয়সায় জনসেবা

কোথাও তালবীজের খোঁজ পেলে চিত্তরঞ্জন ছুটে যান সেখানে। ভবদহ অঞ্চলের ৫০টি গ্রাম থেকে তালবীজ কেনেন তিনি। আবার বিনা পয়সায় কেউ বীজ দিলে খুশিমনে তা নেন। বর্ষা মৌসুমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে এমনকি আবর্জনার স্তূপ থেকেও তালবীজ সংগ্রহ করেন। একেকটা বীজ কিনতে সব মিলিয়ে চার টাকার মতো খরচ হয় তাঁর। নিজের আয়ের একটা অংশ খরচ করেন এর পেছনে। প্রথম দিকে চিত্তরঞ্জনের পরিবারের লোকজন তাঁকে বকাঝকা করত। এখন তারাও সহযোগিতা করে।

অন্য জেলায়ও যাচ্ছেন

এখন যশোরের সীমানা পেরিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায় এই কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিচ্ছেন চিত্তরঞ্জন। গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং পিরোজপুরের কাউখালীতে ১০ হাজার তালবীজ লাগিয়েছিলেন। কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সেবার তাঁকে দুই জায়গা থেকে ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এমন পুরস্কার পেয়ে খুব খুশি চিত্তরঞ্জন। সেটাই ছিল তাঁর জীবনে পাওয়া প্রথম পুরস্কার। ওই পুরস্কারের টাকার অর্ধেক খরচ হয়েছিল। বাকি টাকার সঙ্গে নিজের ৩০ হাজার মিলিয়ে এবার মোট ৫০ হাজার টাকার তালগাছের মাথা (গাছের তাল আর পাতা) কিনেছেন। এ বছর আরো ২০ হাজার টাকার বীজ কিনবেন বলে জানালেন তিনি।

তাঁর গাছ বাঁচাল যাদের

প্রথম দিকে গ্রামের অনেকে ভালোভাবে নেয়নি চিত্তরঞ্জনের এই কাজ। অনেকে পাগলও বলেছে তাঁকে। কিন্তু এত দিন পরে এসে গ্রামবাসী বুঝতে পারছে, এই পাগলামির মূল্য কত। সরখোলা গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন তাঁদের একজন। গতবার বর্ষায় তিনিসহ চারজন মাঠে কাজ করছিলেন। তুমুল বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হলে তিনজন তালগাছের নিচে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আহাদুর নামের আরেকজন ওঠেননি। বলেছিলেন, কাজ শেষ করে একবারেই ক্ষেত ছেড়ে যাবেন। কিন্তু বজ্রপাত তা আর হতে দেয়নি। আলমগীর হোসেন বললেন, ‘তালগাছের নিচে না দাঁড়ালে হয়তো ওই দিন আমরাও মারা যেতে পারতাম। সেদিন বুঝেছি, বিলের মাঝে চিত্তদার তালগাছ কত মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে।’

সমাজসেবীর বসবাস ভাঙা ঘরে!

মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারানো চিত্তরঞ্জন বড় হয়েছেন বাবা-কাকার কাছে। অনটনের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ২১ বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবার ছায়াও। এখন তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ৬৭ বছর বয়সী চিত্তরঞ্জনের সংসার। ৩০ বছর আগে দোচালা টিনের ঘর তুলেছিলেন। মরচে ধরে জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে সেই টিন। সেকালের শক্তপোক্ত জিনিস বলেই হয়তো এটুকু টিকে আছে। বর্ষায় ঘরের ভেতরে পানি পড়ে। কিন্তু টাকার অভাবে টিন বদলাতে পারছেন না। স্বামী পরিত্যক্তা একটি মেয়েও এখন তাঁর পরিবারে থাকেন। এসব জানিয়ে চিত্তরঞ্জন আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘জীবনটা আমার দুঃখের সাগর। সহযোগিতা পেলে অন্তত ঘরটা ঠিক করে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম।’

জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসকের প্রশংসা

চিত্তরঞ্জনের বিষয়ে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বললেন, ‘এ যুগে তাঁর মতো সাদা মনের মানুষ বিরল। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে তাঁর রোপণ করা অসংখ্য তালগাছ এখন দাঁড়িয়ে আছে। অভাবী এই মানুষটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভালো হতো।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদ বলেন, ‘বৃক্ষপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাসকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করার ইচ্ছা রয়েছে। এর মধ্যেই তাঁর পরিবারকে কিছু খাদ্যপণ্য ও উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে অভয়নগরে ১০ লাখ খেজুরবীজ রোপণের প্রক্রিয়া চলমান। প্রাথমিক পর্যায়ে বীজ কেনার জন্য তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।’

কাজ চালিয়ে যাবেন চিত্তরঞ্জন

ভাদ্র-আশ্বিন বাংলা বর্ষপঞ্জীর এই দুটি মাস চিত্তরঞ্জনের অবসর মেলা ভার। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল আর কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। একজন ভ্যানঅলা সঙ্গে চলে তালের বীজ নিয়ে। কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়। রোদ, ঝড়-বাদল যাই হোক না কেন, চিত্তরঞ্জনের এই রুটিনে ছেদ পড়ে না। বললেন, ‘ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাসে তালগাছ না লাগালে আমার হাত নিশপিশ করে। বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। যত দিন বাঁচব কাজটা চালিয়ে যাব।’

সূত্র: কালের কণ্ঠ অনলাইন।

Advertisement