Homeসব খবরজেলার খবর‘বাবা তুই আমার বুকে আয়, তোর বিদেশ লাগবে না’

‘বাবা তুই আমার বুকে আয়, তোর বিদেশ লাগবে না’

তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবে আট বাংলাদেশি মারা গেছেন। এরমধ্যে তিনজনের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। আর রাসেল শেখ মুকসুদপুরের ওই তিনজনের মধ্যে একজন। আটজনের মধ্যে গোপালগঞ্জের তিনজন ছাড়াও বাকি পাঁচজন পার্শ্ববর্তী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার। শুক্রবার (৩ মে) সন্ধ্যায় নিহত তিনজনের মরদেহ মুকসদুপুর উপজেলার নিজ নিজ গ্রামে পৌঁছায়। পরে তাদের মরদেহ দাফন করা হয়।

এ সময় আহাজারি করতে করতে নিহত রাসেল শেখের মা শিল্পী বেগম বলেন, ‘আমার বাবার (ছেলে) স্বপ্ন ছিল বড় ঘর দেবে, ছোট বোনকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে পরে নিজে বিয়ে করবে। আমাগো সবাইরে ভালো রাখবে। আমার বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমার বাবারে ওরা মাইরে ফেলছে। ওদের সঙ্গে কথা ছিল মাছ ধরার বড় ট্রলারে সমুদ্র পার করবে। ওরা ছোট নৌকায়, ৩০ জনের ধারণক্ষমতা সেখানে ৫২ জন পার করতে গিয়ে নৌকার খোলে ঢুকাইয়া মাইরা ফেলছে। আমি ওদের বিচার চাই।’

নিহত রাসেলের বাবা আবুল কাশেম শেখ বলেন, আমি গরিব মানুষ ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় ছোট্ট একটা চায়ের দোকান করে সংসার চালাই। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছি। তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে রাসেল। আমার কষ্ট লাঘব করতে ইতালিতে যেতে চেয়েছিলো। ভেবেছিলো ইতালি গিয়ে আমাকে একটু শান্তি দিবে। রাসেল বাড়ি থেকে যাওয়ার দুই দিন পর আমার মা (রাসেলের দাদি) মারা যায়। মায়ের কুলখানির দিনে ছেলের নিহতের খবর পেলাম। আল্লাহ আমার আর কত পরীক্ষা নিবে। একটু জড়িয়ে ধরতে পারলে বুকের হাহাকার কমতো কিনা? আমার মানিককে যারা এভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে তাদের বিচার চাই।

মারা যাওয়া আটজন হলেন- গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন শেখের ছেলে রিফাত শেখ (২৩), দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্টি গ্রামের মো. রাসেল (২৩) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইমরুল কায়েস আপন (২২) এবং মাদারীপুরের রাজৈরের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), সেনদিয়ার গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪), কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার (২২)।

স্বজনরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে সৌদি এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মরদেহগুলো পৌঁছায়। তখন মরদেহ নিতে ভিড় করেন তারা। কিন্তু ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহগুলো পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।

মুকসুদপুর উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্রি এলাকায় নিহত রাসেল শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে স্বজনদের ভিড়, নিহতের মা শিল্লী বেগম আহাজারি করছেন তাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন প্রতিবেশী ও স্বজনরা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন শিল্পী বেগম। থেকে থেকে স্মৃতি মনে করে হাউমাউ করে কান্না করছেন; বলছেন, বাবা রাসেল তুই আমার বুকে আয়। তোর বিদেশ লাগবে না।

নিহতের মামা মো. কবীর শেখ বলেন, রাসেল চেয়েছিল পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। রাসেল এভাবে দেশে আসবে, সেটা কখনো আশা করিনি আমরা।

তিনি আরো বলেন, দিগনগর ইউনিয়নের কানুরিয়া গ্রামের সুমন বলেছিলো ১৩ লাখ টাকা দিলে রাসেলকে আমরা ইতালি পৌঁছে দিবো। তারা নিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর তাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে, তিনদিন খেতে দেয়নি। তারপর ৩০ জন ধারণ ক্ষমতার একটি ছোট নৌকায় করে ৫২ জন লোক নিয়ে যাত্রা করে। এরমধ্যে ৯ জনকে নৌকার চালির (পাটাতন) নিচে লুকিয়ে নিয়ে যায়; সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। আমরা এ দালালদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করছি। যাতে করে অন্য কোনো মায়ের কোল খালি না হয়।

এদিকে মুকসুদপুরের দিগনগর ইউনিয়নের বড়দিয়া গ্রামে রিফাত শেখের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় রিফাতের মা সুমা বেগম অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কথা বলতে পারছেন না। শুধু বলছেন আমার রিফাতকে কেনো এখনো আমার কাছে আনছে না। আমি রিফাতকে দেখতে চাই। কারো বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই, আল্লাহ আমার রিফাতকে নিয়ে গেছে।

মুকসুদপুর থানার ওসি মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, তিউনিসিয়ায় দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আইনগত সহযোগিতা চাইলে করা হবে। এরমধ্যে সরকারিভাবে মরদেহগুলো দেশে এসেছে। এখন পর্যন্ত কোনো পরিবার থানায় অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।-ডেইলি-বাংলাদেশ

Advertisement