Homeঅন্যান্যভাসমান পদ্ধতিতে অর্গানিক সবজি চাষ

ভাসমান পদ্ধতিতে অর্গানিক সবজি চাষ

বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে অনেক জমি পানিতে তলিয়ে থাকে অথবা দীর্ঘ জলাবদ্ধতার শিকার হয়, আবার কোন কোন এলাকা জোয়ার-ভাটার কারণেও প্লাবিত হয়। সে সব জমিতে কোন ফসল চাষ করা যায় না। এ সময় শাকসবজির প্রাপ্যতাও থাকে কম। এ সব জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে ধাপ তৈরি করে নানা ধরনের সবজি ও মসলা চাষ করা যায়।

ভাসমান বেডে শাকসবজি ও মসলা চাষের উদ্দেশ্য:

  • বন্যা ও জলাবদ্ধ প্রবণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কৌশল হিসেবে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা।
  • দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
  • জলাবদ্ধ এলাকার পানিতে ডুবন্ত ভূমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা এবং বর্ষা মৌসুমে সবজি ও মসলা চাষ সম্প্রসারণ করা।
  • প্রতিকূল পরিবেশ যেমন-বৃষ্টি, বন্যা ও খরার সময় সবজি ও মসলা চাষ করা এবং বন্যার সময় সবজির বীজতলা তৈরি করে মৌসুমী সবজির চারা উৎপাদন নিশ্চিত করা।

ভাসমান বেডে চাষ উপযোগি ফসল:

  • গ্রীষ্ম মৌসুমে কলমীশাক, লাউশাক, ডাটাশাক, ডাটা, ঢেঁড়স, বরবটি, ঝিঙ্গে, শসা, করলা, বেগুন, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, পুঁইশাক, চাল কুমড়া, পানি কচু, হলুদ চাষ করা যায়।
  • রবি মৌসুমে পালংশাক, লালশাক, ধনেপাতা, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, ব্রোকলি, মুলা, গাজর, টমেটো, লাউ, সীম, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ইত্যাদি ফসল চাষ করা যায়।
  • এছাড়া বন্যার কারণে আগামভিত্তিতে সবজি জাতীয় ফসল যেমন-লাউ, সীম, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, বেগুন, মরিচ, টমেটো এবং রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন করা যায়।

ভাসমান বেডে ফসল চাষের সুবিধা:

  • বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন কৌশল হিসেবে ভাসমান ধাপে সবজি ও মসলা চাষ একটি লাগসই প্রযুক্তি।
  • নিচু ও পতিত, জলমগ্ন অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা যায়।
  • স্থায়ী জলাবদ্ধ এলাকায় (খাল, হাওর বা হ্রদে) সারা বছর এ পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা উৎপাদন করা যায়।
  • পরিবেশ বান্ধব ও জৈব পদ্ধতিতে ফসল আবাদ করা যায়।
  • অতিরিক্ত বৃষ্টি ও মৌসুমী বন্যায় ফসলের তেমন ক্ষতি হয় না।
  • কোন সেচ লাগে না।
  • পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির যোগান বাড়ানো যায়।

ভাসমান বেড তৈরির পদ্ধতি: কচুরিপানা, টোপা পানা, শ্যাওলা, বিভিন্ন ধরনের আগাছা, ধানের খড় বা ফসলের অবশিষ্টাংশ প্রভূতি ব্যবহার করে ভাসমান ধাপ তৈরি করা যায়। তবে কচুরিপানা দিয়ে ধাপ তৈরি করা উত্তম। সাধারণত এক শতাংশ আয়তনের ভাসমান বেড তৈরি করতে প্রায় ৫ শতাংশ জায়গার কচুরিপানার দরকার হয়। কচুরিপানা গাদা করে বেড বা ধাপ তৈরি করতে হবে। কচুরিপানার বেড তৈরির পর তার উপর এক স্তর বিন্দাল লতা (এক ধরনের ঘাস জাতীয় আগাছা) বিছিয়ে তার উপর ১৫-২০ সে.মি. পুরু করে পচা টোপা পানা/কচুরিপানা বা কয়ার ডাস্ট (নারিকেলের ছোবড়ার গুড়া) বিছিয়ে দিতে হবে। সাধারণত ভাসমান বেডের মাপ হয় ২০-২২ হাত (১০ মিটার) লম্বা, ২.৫ হাত (১.২৫ মিটার) থেকে ৪-৫ হাত (২ মিটার) চওড়া এবং পানির উপরে ২ থেকে ২.৫ হাত (১ মিটার) উঁচু হয়ে থাকে। নিচে বেড বা ধাপ তৈরির পদ্ধতির বর্ণনা দেয়া হলো:

বেড তৈরির ধাপসমূহ:

  • পানিতে ভেসে থাকা কচুরিপানার স্তর যেখানে ঘন ও লম্বা এমন জায়গা বেছে নিতে হবে।
  • কচুরিপানার ঘন, লম্বা ও পুরু স্তরের উপর একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাঁশ ফেলতে হবে।
  • এরপর বাঁশের উপর দাঁড়িয়ে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে দু’পাশ থেকে কচুরিপানা টেনে এনে বাঁশের উপর স্তরে স্তরে সাজাতে হবে।
  • কচুরিপানার স্তর সাজানোর সময় কচুরিপানা পানিতে যেভাবে থাকে সেভাবে ঘন করে অর্থাৎ খাড়া করে সাজাতে হবে। পরবর্তী অর্ধেক স্তর সজানোর সময় কচুরিপানা উল্টো করে সাজাতে হবে অর্থাৎ এর শিকড় উপরের দিকে থাকতে হবে।
  • তারপর পা দিয়ে চেপে চেপে উঁচু স্তর তৈরি করতে হবে যাতে কোন গ্যাপ বা ফাঁকা জায়গা না থাকে।
  • এরপর স্তূপের উপরে উঠে প্রয়োজনীয় কচুরিপানা তুলে মাপ অনুযায়ী ধাপ তৈরি করতে হবে। ধাপের উপরের অংশে অপেক্ষাকৃত ছোট কচুরিপানা, খুদি পানা, টোপা পানা দেয়া ভাল।
  • বন্যা, ঢেউ বা জোঁয়ার-ভাটার স্রোত থাকলে বেডের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁশের খুঁটি বা বেডের চারপাশে ফ্রেম দিতে হবে।

ধাপে বীজ বোনা ও চারা রোপণ পদ্ধতি: ভাসমান বেড তৈরির পর উপরিভাগ আবাদ উপযোগি হতে প্রায় ১৫-২০ দিন সময় লাগে। বেড তৈরির পর তাতে সারি করে সরাসরি বীজ বোনা যায়। আবার বল বা বিড়ায় তৈরি করা চারা নির্দিষ্ট দূরত্বে বেডে রোপণ করা যায়। আদা, হলুদ, কচু প্রভূতি ফসল সরাসরি রোপণ করা যায়। চারা ৫-৬ ইঞ্চি হলে এবং শিকড়ের মাথা বল থেকে বের হলেই (কালো হওয়ার আগেই) বেডে লাগাতে হবে। বিড়া বা ব্যাগের চারা একত্রে বেডে নির্দিষ্ট পরিমান গর্ত/জায়গা করে রোপণ করতে হবে। বল/বিড়ার আকার ছোট হলে পার্শ্বে পচা কচুরির আস্তরণ দিতে হবে। নতুন আস্তরণের সাথে ১-২ চা চামচ জৈব সার প্রয়োগ করলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়বে। চারা লাগানোর পর সামান্য পানি দিয়ে চারা ও চারার গোড়া ভিজিয়ে দেয়া আবশ্যক। চারা বেশি লম্বা হলে বাউনি/জাংলা দিতে হবে।

সদ্য তৈরি বেডের উপর পচা কচুরিপানা দিয়ে ৩-৪ ইঞ্চি পুরু স্তর তৈরি করে সরাসরি বীজ বপন বা চারা রোপণ করা যায়। লালশাক, পালংশাক, ধনে পাতা, ডাটাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজের জন্য চারার বল তৈরির প্রয়োজন হয় না। বীজ সরাসরি বেডে ছিটিয়ে বা লাইনে বপন করা যায়। সব ক্ষেত্রে বেডের উপর পচা কচুরিপানার একটি স্তর দিয়ে তার উপর বীজ বপন বা চারা রোপণ করা হয়। অধিক ফলন পাওয়ার জন্য ভাসমান বেডে ঢেঁড়শ, টমেটো, বেগুন, কলমিশাক ইত্যাদি ফসলের সাথে আন্ত-ফসল ও মিশ্র ফসল হিসেবে ঝিঙ্গে, লালশাক, পুঁইশাক, ধনিয়া, ডাঁটা প্রভূতি চাষ করা যায়।

ভাসমান ধাপে ফসলের পরিচর্যা:

  • ভাসমান ধাপের পচনশীল দ্রব্য দ্রুত পচানোর জন্য বীজ বপন বা চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার পানিতে গোলে বেডে ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।
  • ভাসমান ধাপে আগাছা জন্মালে তা হাত দিয়ে পরিস্কার করে দিতে হবে।
  • ভাসমান ধাপে সাধারণত কোন রাসায়নিক সার দেয়ার দরকার হয় না, তবে গাছের বাড়-বাড়তি ও ফলন কম মনে হলে সুপারিশকৃত মাত্রায় সার দেয়া যেতে পারে।
  • লাউ, মিষ্টি কুমড়া, সীম, বরবটি ইত্যাদি লতানো গাছের বাউনির জন্য ধাপের পাশে বা ধাপের মধ্যে কঞ্চি ও ডালপালা পুঁতে দিতে হবে।
  • অনেক সময় ধাপ তীব্র স্রোতে বর্ষার পানিতে ভেসে যেতে পারে, সেজন্য বাঁশ পুঁতে বেডগুলো মাটির সাথে আটকে রাখতে হবে।
  • ইঁদুর ও হাঁসের উপদ্রব প্রতিরোধের জন্য বেড বা কয়েকটি বেডের চারদিকে নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
  • ফসলে বিভিন্ন রোগের আক্রমন দেখা দিলে রোগাক্রান্ত পাতা, ফল বা অংশসমূহ হাত দিয়ে তুলে ধ্বংস করতে হবে।
  • বিভিন্ন পোকামাকড় ভাসমান বেডে ফসলের ক্ষতি করতে পারে, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৩০-৪০ গ্রাম গুড়া সাবান গুলে আক্রান্ত গাছে স্পে করা যেতে পারে।

Advertisement