Homeঅন্যান্যরিজার্ভের উন্নতি না হলে টাকার দরপতন আরো বাড়বে

রিজার্ভের উন্নতি না হলে টাকার দরপতন আরো বাড়বে

গত এক যুগে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০১০ সালের শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা। বর্তমানে তা ৯৫ টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত হার অনুযায়ী। যদিও বাজারে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দরে বাজারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এখনো রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ১১০ টাকার বেশি দরে। ব্যাংকের এ দর আমলে নিলে এ এক যুগে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬০ শতাংশেরও বেশি।

বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। ২০২১ সালে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানি দায় পরিশোধ করার জন্য গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়। আর চলতি আগস্টেও প্রায় একই পরিমাণ ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক যুগে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে দুই দফায়। প্রথম দফায় ২০১১-১২ অর্থবছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয় ১১ শতাংশ। ৭১ টাকা থেকে বেড়ে এক লাফে ডলারের বিনিময় হার ৭৯ টাকায় উঠে যায়। এর পরের পাঁচ বছর প্রতি ডলারের মূল্য ৭৭ থেকে ৭৯ টাকার মধ্যেই ওঠানামা করেছে। ২০১৮ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ টাকায়। গত বছরের জুন পর্যন্তও প্রতি ডলারের বিনিময় হার সীমাবদ্ধ ছিল ৮৪ টাকায়। চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে ৮৬ টাকায় বিনিময় হওয়া ডলার আগস্টে এসে ৯৫ টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু এ ধাপেই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হলেও বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চাহিদা ও জোগানের ওপর ডলারের বিনিময় হারকে ছেড়ে না দিয়ে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখার চর্চা হচ্ছে বহুদিন ধরে। বৈদেশিক মুদ্রার চাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালে তখনই একসঙ্গে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এক ধাক্কায় বড় মাত্রায় অবমূল্যায়ন করতে গিয়ে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, অন্যদিকে কঠিন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।

কৃত্রিম উপায়ে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়া অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। এ অর্থনীতিবিদের ভাষ্য হলো, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ধীরে ধীরে রুপির অবমূল্যায়ন করেছে। এ কারণে হঠাৎ করে দেশটির জনগণের ওপর অসহনীয় চাপ তৈরি হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে ডলারের দাম চেপে ধরে রাখা হয়। চাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালে হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে বিনিময় হারের অভিঘাত জনগণের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে গড়ে ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। সে হিসাবে ৪০ শতাংশের অবমূল্যায়ন খুব বেশি নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ সামগ্রিক অর্থনীতি যে পরিমাণ চাপের মধ্যে আছে, তাতে চলতি বছরের মধ্যেই ডলারে বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়াবে।

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য, সুদের হার, রাজস্ব ও মুদ্রানীতিসহ পারিপার্শ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবেশী ও সমঅর্থনীতির দেশগুলোর বিনিময় হারকেও এক্ষেত্রে আমলে নেয়া হয়। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার ৭৭ থেকে ৭৯ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময়েও কৃত্রিম উপায়ে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

টানা পাঁচ বছর একই বিনিময় হার ধরে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সে সময়ে চাহিদার চেয়ে ডলারের জোগান বেশি ছিল। এ কারণে অনেক সময় বাজার থেকে ডলার কিনে নিতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে টাকার যে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, সেটিও খারাপ হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধীরে ধীরে ডলারের দাম বাড়িয়েছে। বর্তমান গভর্নর বলেছেন, দুই-তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ডলার-টাকা বিনিময় হারকে আরো বাজারনির্ভর করার আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি। এটিই সঠিক উপায়। বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিশ্চয় স্থিতিশীল করা সম্ভব।

২০১৮ সাল থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল ২০১৯ সালেও। চাহিদা ও জোগানের সামঞ্জস্য না থাকলেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ডলারের বিনিময় হার বাড়তে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি ডলারের গড় বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা। যদিও ওই সময় অর্থনীতিবিদরা ডলারের দাম পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও মনে করছেন এতদিন কৃত্রিম উপায়ে টাকার মান ধরে রাখা হয়েছিল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে থেকেই আমরা ডলারের বিনিময় হার পুনর্মূল্যায়নের পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। মুদ্রানীতিতে বিনিময় হারকে যতটা গুরুত্ব দেয়ার দরকার ছিল, সেটি হয়নি। দরকার ছিল ডলারের বিনিময় হারকে ধীরে ধীরে বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়া। কিন্তু সেটি না করে অনেকটা কৃত্রিম উপায়ে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা হয়েছিল। এখন পরিস্থিতির চাপে একসঙ্গে বড় অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি এত বড় অভিঘাত নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৯ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলারের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়। রেকর্ড এ আমদানির ফলে গত অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। রফতানি আয়ের পাশাপাশি রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত ডলার দিয়ে আমদানি ব্যয় সমন্বয় করে বাংলাদেশ। তবে রেকর্ড আমদানির বছরে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে যায়। এ কারণে অর্থবছর শেষে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়েছে।

সূত্র: বণিক বার্তা।

Advertisement