Homeসব খবরআন্তর্জাতিক‘বন বিভাগে ফোন করে বললাম, বাড়ির পাঁচিলে বাঘ ঘুমাচ্ছে’

‘বন বিভাগে ফোন করে বললাম, বাড়ির পাঁচিলে বাঘ ঘুমাচ্ছে’

ভারতের উত্তরপ্রদেশের পিলিভিটের বাসিন্দা জসবিন্দর সিং দুধের ব্যবসায়ী। পিলিভিট ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্র থেকে আনুমানিক ১২ কিলোমিটার দূরে তাদের গ্রাম। তাই আসা যাওয়ার পথে দূর থেকে বাঘের দেখা মেলাটা তার কাছে খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। যেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সেটা হল, বাঘ স্বয়ং উদয় হয়ে তার বাড়ির পাঁচিলে রাত কাটাবে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি ভাবিনি ২৫ ডিসেম্বরের রাতটা এইভাবে কাটবে। রাত সাড়ে ১২ বা ১টা হবে। ঘরের বাইরে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা আওয়াজে দেখি বাড়ির পাঁচিলে বড়সড় কিছু একটা বসে আছে। প্রথমে বুঝিনি, তারপর ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি আরে! এটা তো একটা বাঘ। পরে অবশ্য জেনেছিলাম সেটা বাঘিনী।’

ঘটনাটা পিলিভিটের আটকোনা গ্রামের। ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রের জন্য পরিচিত পিলিভিট এখন খবরের শিরোনামে। কারণ বছর দুই-আড়াইয়ের এক বাঘিনী উপস্থিত হয় প্রথমে জসবিন্দর সিংয়ের বাড়ির পাঁচিলে ও পরে তার ভাই সুখবিন্দর সিংয়ের বাড়ি।

প্রায় ঘণ্টা বারো সেই গ্রামকেই আস্তানা করেছিল সে। আটকোনা গ্রামে আসা সেই অতিথিকে দেখতে আশপাশের গ্রাম থেকে জড়ো হয় কয়েক হাজার মানুষ। মুহূর্তে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় পিলিভিটের সেই ছবি।

জনতার উৎসাহ ছিল ঘুমন্ত বাঘিনীকে ঘিরে, যদিও বাঘিনী আশপাশে জড়ো হওয়া উৎসাহী জনতাকে নিয়ে খুব একটা ভাবিত ছিল না।

পরে বন দপ্তরের আধিকারিকরা তাকে উদ্ধার করে। পিলভিট ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ডিরেক্টর নবীন খন্ডেলওয়াল বলেন, ‘আমরা ভোরের দিকে খবরটা পাই। সঙ্গে সঙ্গে আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান।’

‘যেহেতু বাঘটি লোকালয়ে এক ব্যক্তির বাড়িতে ছিল, তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পরে সমস্ত নিয়ম মেনে তাকে ট্র্যাঙ্কুইলাইজারের সাহায্যে ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আপাতত তার চিকিৎসা চলবে এবং পরে তাকে সংরক্ষিত এলাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’

‘বাড়ির পাঁচিলে বাঘ’

বড়দিনের আগের রাতে সান্তা ক্লজের পরিবর্তে এমন কাউকে একেবারেই আশা করেননি জসবিন্দর সিং। সাহায্যের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘খুব চিন্তা হচ্ছিল। ভাগিস্য বাড়িতে খুব বেশি লোক ছিল না। পুলিশ, বনবিভাগ সবাইকে ক্রমাগত ফোন করছিলাম। তাদের ফোন করে বললাম আমার বাড়ির পাঁচিলে বাঘ ঘুমোচ্ছে। হাতের কাছে যা ছিল সেটা ছুঁড়তে থাকি। কিন্তু ভয়ও হচ্ছিল যদি ভয় পেয়ে বাঘটা পালানোর সময় কাউকে আক্রমণ করে।’

ভয় পেয়ে পালানোর সময় একটি কুকুর এসে পড়ে ওই বাঘিনীর সামনে। জসবিন্দর প্রথমে সেই কুকুরটিকে বাঁচান আর তারপরে ধাওয়া করেন তাদের গ্রামের নতুন অতিথিকে। ততক্ষণে অবশ্য সে ঢুকে পড়েছে ভাই সুখবিন্দর সিংয়ের বাড়িতে।

বাঘিনীটা অবশ্য প্রথমেই পাঁচিলকে বেছে নেয়নি তার পরবর্তী ঠিকানা হিসাবে। পাঁচিল ডিঙিয়ে প্রথমে সে এসে পড়ে সুখবিন্দর সিংয়ের গাড়ির ছাদে। পাঁচিলের কাছেই পার্ক করা ছিল তাঁর গাড়ি। আওয়াজ শুনতে পেয়ে তাঁর বয়স্ক মা নাতিকে ডাকেন।

কেন বারবার বাঘ লোকালয়ে

আটকোনা বা তার আশপাশের অঞ্চলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বা চিতা বাঘের আনাগোনা নতুন নয়। সুখদীপ সিং-সহ ওই গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, আশপাশের অঞ্চলে বাঘ তারা আগেও দেখেছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, গত কয়েক বছরে এ জাতীয় ঘটনা বেড়েছে।

এ বিষয়ে ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (হিউম্যান-ওয়াইল্ডলাইফ কনফ্লিক্ট ডিভিশন) প্রধান ড. অভিষেক ঘোষাল বলেন, ‘তরাই অঞ্চলে লোকালয়ে বাঘ চলে আসাটা নতুন নয়। ওই অঞ্চলে লোকালয়ে বাঘ চলে আসার একাধিক কারণ হতে পারে। যেমন বাঘ যদি অসুস্থ বা সন্তানসম্ভবা হয়, অথবা সে বুড়ো হয়ে গিয়েছে, শিকার ধরে পারে না। বনে লাইভ স্টক কমে আসাটাও বাঘ লোকালয়ে চলে আসার অন্যতম কারণ। আসলে ওরা ঘন গাছপালা যুক্ত জায়গা পছন্দ করে। আর বাঘের কাছে আখের ক্ষেত আর বনের মধ্যে খুব একটা তফাত নেই। সে কারণেও চলে আসতে পারে।’

তিনি জানিয়েছেন, বাঘ মানেই যে সে নরখাদক এমনটা নয়। বাঘ মানেই যে নরখাদক এটা ভাবা ভুল। বাঘ মানুষকে আক্রমণ করে তাকে খেয়েছে এমন ঘটনা বিশেষ একটা দেখা যায় না। তারা আক্রমণ করে ভয় থেকে।

একই মত পোষণ করেন জয়দীপ কুণ্ডু। বন্যপ্রানী সংরক্ষণের বিষয়ে প্রচার করেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘পিলিভিটের মতো ঘটনা ভারতের অন্যান্য অনেক জায়গায় দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনও তাদের মধ্যে একটি। সেখানেও বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। তার কারণ বিভিন্ন। যেমন পথ হারিয়ে ফেলেছে, কিম্বা তাদের চেয়ে শক্তিশালী কোনও বাঘ ওই অঞ্চলে চলে এলে তারা এলাকা ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।’

বন্যপ্রাণী দেখলে ভয় পেয়ে তাকে মারধরের একাধিক ঘটনার অভিযোগ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শোনা গিয়েছে। এই জাতীয় ঘটনা এড়াতে এলাকাবাসীদের সচেতন করাটা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার সুন্দরবন অঞ্চলের ফিল্ড অফিসার সম্রাট পাল বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের সচেতন করাটা খুব প্রয়োজন। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার নিজস্ব রেসপন্স টিম আছে যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, এলাকায় বন্যপ্রাণী চলে আসলে কী করা উচিত। মানুষ কিন্তু আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছেন। তারা বুঝেছেন তাদের সঙ্গেই বন্য প্রাণীদের ভাল থাকাটাও কতটা প্রয়োজন।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Advertisement