Homeসব খবরজাতীয়কোরবানি: পশু হিসেবে উট, দুম্বা, মহিষ, ভেড়া, গাড়লের চাহিদা...

কোরবানি: পশু হিসেবে উট, দুম্বা, মহিষ, ভেড়া, গাড়লের চাহিদা কম কেন?

বাংলাদেশে ঈদ-উল-আজহায় কোরবানির জন্য পশু হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় গরু। আর এর পরেই আছে ছাগল। তবে এছাড়াও যেসব পশু কোরবানি করতে মানা নেই – যেমন, মহিষ, ভেড়া, উট, দুম্বা, গাড়ল – এসব পশু কোরবানির ক্ষেত্রে তেমন জনপ্রিয় নয়। বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও অবশ্যই এমনই আভাস দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী, এবার ঈদে আনুমানিক ৯৭ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি পশু কোরবানি করা হবে।

এই চাহিদার বিপরীতে এক কোটি ২১ লাখের বেশি পশু প্রস্তুত রয়েছে। কোরবানির জন্য বাংলাদেশে যে পরিমাণ পশু প্রস্তুত করা হয়েছে তার মধ্যে গরুর সংখ্যা ৪৪ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি। এই সংখ্যা কোরবানির জন্য গরুর সম্ভাব্য চাহিদার তুলনায় পাঁচ লাখ বেশি।

চাহিদা কম

গরুর মতো বেশি পরিমাণ মাংস হওয়া সত্ত্বেও মহিষ প্রস্তুত রয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজারের কিছু বেশি। ঈদে কোরবানি যোগ্য ছাগলের সংখ্যা ৬৫ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি। আর ভেড়া রয়েছে ৯ লাখ ৩৭ হাজারের কিছু বেশি।

‘কোরবানির সময় এত গরু, বছরের অন্য সময় সঙ্কট কেন’?

স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, গরু এবং ছাগলের তুলনায় বাজারে মহিষ ও ভেড়ার চাহিদা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম।অন্য যেসব পশু রয়েছে যেমন উট, দুম্বা এবং গাড়ল-এসবের চাহিদা নেই বললেই চলে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক জিনাত সুলতানা বলেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, উট, দুম্বা এবং গাড়ল মিলিয়ে কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে মাত্র ১,৪০৯টি পশু। বাংলাদেশে এসব পশুর তেমন চাহিদা নেই বলে জানান মিজ সুলতানা।

ভেড়া

কোরবানির পশু হিসেবে ছাগলের তুলনায় ভেড়ার চাহিদা বেশ কম। আর এ কারণেই ছাগলের তুলনায় ভেড়ার যোগানও ঈদকে ঘিরে কম থাকে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ঈদকে সামনে রেখে ভেড়ার তুলনায় এবার ৫৬ লাখ বেশি ছাগল উঠবে কোরবানির বাজারে।

খামারিরা বলছেন, ভেড়ার মাংসে বেশি পরিমাণে জিঙ্ক এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কম পরিমাণে থাকলেও এটি ছাগলের তুলনায় বেশি জনপ্রিয় নয়। সবচেয়ে বেশি ভেড়া উৎপাদিত হয় রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং রংপুর বিভাগে।

মহিষ

বাংলাদেশে মহিষের জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে সেটি গরুর মতো এতো বেশি জনপ্রিয় নয়। এ বছর যে পরিমাণ গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে সে তুলনায় মহিষের সংখ্যা অনেক কম। গরুর তুলনায় মহিষ মাত্র দুই শতাংশের কিছু বেশি। তবে মহিষের মাংসের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছে।

গরুর মাংসের তুলনায় মহিষের মাংস স্বাস্থ্য-গুণে ভাল বলে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জিনাত সুলতানা। তিনি বলেন, গরুর মাংসে যেমন অনেক বেশি পরিমাণ চর্বি জমে, মহিষের মাংসে তেমন চর্বি থাকে না। এছাড়া পুষ্টি-গত দিক থেকেও গরুর মাংসের তুলনায় মহিষের মাংস বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। বাংলাদেশের ভোলা, জয়পুরহাট, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগের বেশ কিছু এলাকায় মহিষের খামার গড়ে উঠেছে।

উট ও দুম্বা

ঢাকার কমলাপুর এলাকায় একটি উটের খামার রয়েছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।এছাড়া নাটোরে কিছু মিশ্র খামারে দুম্বার লালন পালন হচ্ছে বলেও জানা যায়। তবে বাংলাদেশে উটের তেমন একটা বাজার নেই বলেও জানান তিনি।

মিজ সুলতানা বলেন, উট এবং দুম্বা এই অঞ্চলের পশু নয়।বরং এগুলো উষ্ণ আবহাওয়া বিশেষ করে মরু এলাকায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে চাষ করতে হলেও সেখানে বিশেষ ধরণের পরিবেশ বানাতে হয় যা ব্যয়বহুল।

আর তার উপর চাহিদা কম এবং উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে এসব পশুর খামার গড়ে তুলতে আগ্রহী হন না কৃষকরা।

গাড়ল

গাড়লের চাহিদা বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বাড়ছে বলেও জানায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। একই ধরণের তথ্য দিয়েছেন খামারিরাও। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে গাড়লের উৎপত্তি রাজশাহীতে। তবে এটি এখান সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। এর মাংস অনেকটা ভেড়ার মাংসের মতোই।

কী বলছেন খামারিরা?

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গবাদিপশুর খামার গড়ে তুলেছেন ইফতেখার আহমেদ। অনলাইনে জীবন্ত পশু কেজি হিসেবে বা লাইভ-ওয়েট প্রক্রিয়ায় পশু বিক্রি করে থাকেন তিনি। তার খামারে ছাগলের পাশাপাশি ভেড়া এবং গাড়লও রয়েছে। এই মুহূর্তে তার খামারে আনুমানিক ১৫০টি থেকে ১৭০টি ভেড়া ও গাড়ল রয়েছে বলে জানান মি. আহমেদ।

কোরবানি উপলক্ষে যেসব পশু বিক্রি হয়ে গেছে সেগুলো ক্রেতাদের ঠিকানায় এরইমধ্যে পৌঁছে দিতে শুরু করেছেন তিনি। মি. আহমেদ জানান, এবার ঈদে ৪০টির বেশি ছাগল বিক্রি করেছেন তিনি। অন্যদিকে ভেড়া ও গাড়ল বিক্রি করেছেন মাত্র ৬টি।

ইফতেখার আহমেদ জানান, কোরবানির পশু হিসেবে ভেড়া বা গাড়ল মানুষ তেমন একটা পছন্দ করে না। তিনি বলেন, “ছাগল আর ভেড়ার মধ্যে জনপ্রিয়তা হিসাব করলে ৯৫% মানুষ ছাগল পছন্দ করে। আর ভেড়ার জনপ্রিয়তা হয়তো ৫% হতে পারে।”

তার মতে, মানুষ আসলে প্রচলিত নয় এমন কোন কিছু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে চান না। আর এ কারণেই ভেড়া এবং গাড়ল কম জনপ্রিয়। কারণ অনেকেই ভেড়ার মাংস খান না। তিনি বলেন, “যে ভেড়া কিনেছেন তিনি মূলত শখের বসেই কিনেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।” তবে কোরবানি না হলেও প্রচলিত বাজারে তিনি নিয়মিতই ভেড়া বিক্রি করেন বলে জানান। গাড়ল বিষয়ে মি. আহমেদ বলেন, এই পশুর চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

গরু সবচেয়ে জনপ্রিয় কেন?

বাংলাদেশে কোরবানির পশু হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পশু বলতে গরুকেই বোঝানো হয়। এর বিভিন্ন রকম কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভোক্তারা। নাদিরা জাহান, যিনি একজন চাকরিজীবী, তিনি জানান, প্রতিবারের মতো এবার ঈদেও গরু কোরবানি দিচ্ছেন তিনি।

গরুকে বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গরু কোরবানি দিতেই তার ভাল লাগে। এছাড়া গরুর মাংস তার ভীষণ প্রিয়। বেসরকারি চাকরিজীবী জান্নাতুল ফেরদৌসি বলেন, এক সময় ভেড়া কোরবানি দিয়েছেন তিনি। তবে এখন আর ভেড়া দেয়া হয় না। কোরবানির জন্য এখন গরুকেই বেছে নেন তিনি।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমার শ্বশুড় আসলে গরু ছাড়া অন্য কোন প্রাণী কোরবানি দেয়াটা পছন্দ করেন না। এজন্য গরুই দেয়া হয়।”

এছাড়া তার সন্তানরাও গরু কোরবানি দেয়াটাই পছন্দ করে। “গরু বেশ বড়-সরো, দেখতেও ভাল্লাগে, বাচ্চারা এজন্যই এটা অনেক পছন্দ করে।”

মিজ ফেরদৌসি মনে করেন, বিভিন্ন পরিবারে গরু কোরবানি দেয়ার পেছনে ‘সৌশ্যাল স্ট্যাটাস’ বা সামাজিক মর্যাদার বিষয়টিও কাজ করে। তিনি বলেন, একটি গরু এক সাথে সব ভাই-বোনরা মিলে মিশে দেয়া যায়। আনন্দ হয়। কিন্তু ছাগলের ক্ষেত্রে বিষয়টি এক রকম নয়। মাংস ভাগাভাগিতেও ছাগলের চেয়ে গরু একটু বেশি সুবিধার বলেও মনে করেন তিনি।

“যাকে দেয়া হয়, সেও একটু বেশি মাংস পায়। আর ছাগল হলে তো মাংস কম হয়, মোট কথা ডিস্ট্রিবিউশনে(বণ্টনে) সুবিধা,” বলেন তিনি।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Advertisement