Homeঅন্যান্য২টি লিচুর দামে ১ কেজি চাল!

২টি লিচুর দামে ১ কেজি চাল!

উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয় লিচুর রাজ্য। রং, গন্ধ, স্বাদ ও মিষ্টতায় ভরপুর এই জেলার লিচুর কদর আছে দেশজুড়ে। তাই তো প্রতি বছর এখান থেকে মৌসুমি ফলটি প্রচুর পরিমাণে যায় ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়া, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায়।

এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে ব্যতিক্রম হয়েছে দামে। দিনাজপুরে যে দামে লিচু বিক্রি হচ্ছে, সেই হিসাবে মাত্র দুটি লিচু বিক্রি করেই কেনা যাচ্ছে এক কেজি চাল। বর্তমানে জেলায় সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চায়না থ্রি জাতের লিচু। আকারভেদে এই লিচু প্রতি হাজার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা করে। এ হিসাবে প্রতিটির দাম ২৬ টাকা। এতে বাগানিরা বেজায় খুশি হলেও আশাহত হয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। এই লিচু তাদের নাগালের বাইরে।

দিনাজপুরে সবচেয়ে বড় লিচুর বাজার বসে শহরের গোড়-এ শহীদ ময়দানে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বোম্বাই জাতের লিচু প্রতি হাজার বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। বেদানা ৮ থেকে ১৩ হাজার, হাড়িয়া ৮ থেকে ১২ হাজার এবং চায়না থ্রি ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত চার-পাঁচ দিন আগে বাজারে ওঠা গোলাপি জাতের লিচু বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার এবং লংগদানা বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেসব লিচু আকারে বড় সেগুলোর দাম বেশি, ছোটগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব জাত ও ধরনের লিচুর দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আগের সপ্তাহে বোম্বাই লিচুর হাজার ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বেদানা বিক্রি হয়েছে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায়, হাড়িয়া ৩ থেকে ৫ হাজার এবং চায়না থ্রি বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে এখন বাজার নিম্নমুখী বলে অনেকেই জানিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, সাধারণত লিচু ওঠে প্রতি বছর ২২ মের পর। এবার অন্তত ১২ দিন আগেই পাক ধরায় বাজারে আগেভাগেই আনা হয়েছে, পাওয়া যাবে জুন মাসজুড়েই। এ বছর প্রথমে বাজারে আসে মাদ্রাজি জাতের লিচু, এরপর আসে বোম্বাই। জুনের শুরুতে বাজারে ওঠে বেদানা ও চায়না থ্রি জাতের লিচু। তবে সময় থাকলেও শেষ হয়ে গেছে মাদ্রাজি লিচু, আর কাঁঠালি বাজারে উঠতে আরও দু-চার দিন লাগবে। এবারে লিচু আগেভাগে বাজারে আসায় শেষও হবে নির্ধারিত সময়ের আগে।

জেলার বিরলের বাগানি রাসেল ইসলাম বলেন, বোম্বাই লিচু এনেছিলাম দুই ভ্যান। প্রতি হাজারে ২১০০ টাকা পেয়েছি। তবে আগের দিন মঙ্গলবার ২৭০০ টাকা করে ছিল। দাম কমতে শুরু করেছে। তবে এবার দাম ভালো পাওয়ায় বেশ লাভ হয়েছে। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা বাগান ব্যবসায়ী আজাহার আলী বলেন, এবারে লিচুর ফলন কম, তাই দাম বেশি। দিনাজপুরের মাসিমপুর এলাকার বাগানি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, এবার প্রচুর মুকুল এসেছিল। অতিরিক্ত তাপে সেগুলো জ্বলে যাওয়ায় ফলন কম হয়েছে। তবে বাজার চড়া থাকায় গত দু’বছর করোনার কারণে যে লোকসান হয়েছিল, তা পুষিয়ে নিতে পারছি।

কুমিল্লা থেকে আসা ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান বলেন, যে দামে লিচু কিনতে হচ্ছে, সে দামে ঢাকায়ও বিক্রি করা কষ্টকর। ভোক্তার সংখ্যা ঠিক থাকলেও বিক্রির পরিমাণ কম। তার পরও লাভ হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা মুসা মিয়া বলেন, এত চড়া দামে লিচু কিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্রি করে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।

দিনাজপুর শহরের ইত্যাদি ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী আবদুর রাজ্জাক বলেন, দিনাজপুর লিচুর জন্য বিখ্যাত হলেও এবার উৎপাদন কম হয়েছে। এজন্য দাম বেশি। তাই লিচু কেনার হার কমেছে। যিনি আগে ২০০ লিচু কিনতেন, তিনি নিচ্ছেন ৫০টি। নিম্ন আয়ের মানুষের চাল কিনতেই হিমশিম অবস্থা, লিচু কিনবে কীভাবে? হেলাল ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী হেলাল উদ্দিন বলেন, ২৬ বছর ধরে এই শহরে লিচুর ব্যবসা করছি, এত দাম কখনোই বাড়েনি।

লিচু কিনতে এসে দাম শুনে চোখ কপালে ওঠে জেলার উত্তর বালুবাড়ী এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবার লিচুর দাম অনেক বেশি। মৌসুমি এই ফল আর নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা জোবাইদুর রহমান বলেন, প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লিচু পাঠাতে বলেন। এবার তারা দাম শুনে বিশ্বাস করছেন না। গত এক যুগেও লিচুর এমন চড়া বাজার দেখিনি। আরেক ক্রেতা সুমন বলেন, লিচুর দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হয়েছে। এই জেলার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। নিজ জেলায় উৎপাদিত এই রসালো ফল হয়তো তাঁদের মুখেই চড়বে না। সিন্ডিকেট করে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা উচিত।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান বলেন, দিনাজপুরে ৫ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। এবার মৌল ভালো এলেও ফলন কম হয়েছে। তার পরও বাজার ভালো থাকায় বাগানিরা লাভবান হবেন।

Advertisement