Homeঅন্যান্যবিলুপ্তপ্রায় গ্রামবাংলার মাটির ঘর

বিলুপ্তপ্রায় গ্রামবাংলার মাটির ঘর

‘মাইট্টা গুদাম টইনুর ছানি ঝরঝরাইয়া পড়ে পানি, আই ভিজিলে যেমন তেমন তুঁই ভিজিলে পরান ফাঢি যায়, ও হালাচান গলার মালা পেট পুরেদ্দে তুয়ারলাই’ এটি চট্টগ্রামের একটি জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কক্সবাজারের শিল্পী বুলবুল আক্তারের গাওয়া গানটি খ্যাতিমান শিল্পী পার্থ বড়ুয়া ও নিশিতার কণ্ঠে দেশজুড়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গানের এক কলিতে মাটির ঘরের কথা উল্লেখ করে শিল্পী এই কলিটি বলেন। চলিত ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘মাটির ঘরে টিনের ছাউনি দেয়া, বৃষ্টি হলে ঝরঝরে পানি গড়িয়ে পড়ে, আমি ভিজলে কোনো সমস্যা নেই তবে প্রেমিকা ভিজলে পরান ফেটে যায়।’ শুধু চট্টগ্রামের এই গানটিতে নয়, এভাবে আঞ্চলিক এবং দেশীয় অনেক গানজুড়ে রয়েছে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির ঘরের কথা।

তবে কালের বিবর্তনে এসব মাটির ঘর এখন বিলুপ্ত প্রায়। জানা যায়, মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রতুলতা আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে আগ্রহী ছিল। এ ছাড়া টিনের ঘরের তুলনায় মাটির ঘর অনেক বেশি আরামদায়ক। তীব্র শীতে ঘরের ভেতরটা থাকে বেশ উষ্ণ। আবার প্রচণ্ড গরমেও ঘরের ভেতর থাকে তুলনামূলক শীতল। এ জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় মাটির ঘরের আধিক্য ছিল বেশি।

গ্রাম বাংলার আদি ঐতিহ্য মাটির ঘর। চারদিক মাটির দেয়াল, উপরে টিন বা ছনের ছাউনি বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে করিয়ে দেয় তাদের শৈশব। কনকনে শীতে ঘরের ভেতর উষ্ণ পরিবেশ ও গরমকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বিরাজ করায় মাটির ঘর গরিবের কাছে যেমন আরামের তেমনি ধনীদের কাছে ছিল বিলাসিতা। তবে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে অস্তিত্ব বিলীনের পথে মাটির ঘর।

এক সময় মফস্বলের প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যেত এই মাটির ঘর। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পূর্ব-পুরুষের তৈরি ঘরগুলো এখন ইট, বালু, রড, সিমেন্টের ঘরে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা করছেন টিনের ঘর। ঘরগুলোর নির্মাণ কৌশলও কত সুন্দর! পানির সঙ্গে মাটির প্রলেপ মিশিয়ে লেপে নিলেই কোনো ফাটল দেখা যায় না। কোনো কোনো সময় অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরগুলো বেশি নষ্ট বা ফেটে গেলে সিমেন্ট দিয়েও লেপে দেয়া হতো।

যারা মাটির ঘর নির্মাণ করেন তারা ‘দেয়ালি’ নামে পরিচিত। সচরাচর এঁটেল মাটি দিয়ে এসব ঘর তৈরি করা হয়। পরিচ্ছন্ন মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে ইটের মতো সারি সারি করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়। প্রতিবারে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু করে ক্রমে শুকিয়ে গেলে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়, টালি বা টিনের ছাউনি দেয়া হতো। মাটির ঘর অনেক সময় দোতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত করা হতো। প্রতিটি ঘর তৈরিতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ বসতঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তুলতেন। বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর শতাধিক বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। তবে মুষলধারে বৃষ্টিতে মাটির ঘরের স্বাভাবিক কাঠামো নষ্ট হওয়ায় লোকজন এই ঘর তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

পূর্ব-পুরুষের স্মৃতি হিসেবে এখনো বেশ কিছু জায়গায় মাটির ঘর দেখা যায়। রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের পাচাইখাঁ এলাকায় এখনো কিছু মাটির ঘর রয়েছে। জয়পুরহাটের কিছু কিছু এলাকাতেও এখনো মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়। একচালা ঘরগুলোর চারদিক দেয়াল উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখতে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর। নওগাঁয় রয়েছে ১০৮ কক্ষের মাটির প্রাসাদ।

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামে ৩৩ বছর ধরে টিকে আছে বাড়িটি। এছাড়াও বগুড়ার নন্দীগ্রামে ১২ শতক জমির উপর তিনতলা মাটির ঘর দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ লেখক জামাল উদ্দিন বলেন, মাটির ঘর কমে যাওয়ার বিষয়টি একটি সভ্যতার চলমান ধারা। এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ গুহায় বাস করত। এরপর ধীরে ধীরে ঘর বানিয়ে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। তারপর স্থানীয় প্রভাবশালী, মাতব্বররা টেকসই এবং আরামদায়ক হওয়ায় মাটির ঘর তৈরি করতে শুরু করে। ‘মাটির ঘর টিনের ছাউনি’ ঐতিহ্য বহন করে।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিল্পায়নের প্রভাবে এখন বড় বড় দালানকোঠা মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারাটা শুরু হয় মূলত গ্রাম অঞ্চলের মানুষ যখন থেকে বিদেশে গমন করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে শুরু করেছে ঠিক তখন থেকে। আমরা প্রথম প্রথম দেখেছি কেউ একজন বিদেশ গেলে অর্থ উপার্জন করে তার প্রথম কাজ ছিল একটা পাকা ঘর তৈরি করা। আর এখন জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচার জন্যই মানুষ ধীরে ধীরে টেকসই আবাসস্থল তৈরি করছে। গত কয়েক যুগ আগে এঁটেল মাটি দিয়ে যে ঘর বানানো হতো তা আমাদের বর্তমান নতুন প্রজন্ম জানে না। তাদেরকে বুঝানোর জন্য এই মাটির ঘরকে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা উচিত।

Advertisement