Homeসব খবরজেলার খবরবিক্রি নয়, ছেলেকে দত্তক দিতে চেয়েছিলেন সোনালি চাকমা

বিক্রি নয়, ছেলেকে দত্তক দিতে চেয়েছিলেন সোনালি চাকমা

আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে গেছেন অনেক আগে। আমার এই সন্তানকে আমার প্রাণের চেয়েও অনেক ভালোবাসি। আমার সন্তানকে অন্য কারও কাছে দিতে চাই না। কিন্তু আমি কোনো কাজ করতে পারি না। থাকার কোনো জায়গা নেই। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সচ্ছল পরিবারের কাছে ওকে দত্তক দিতে চেয়েছিলাম। তবে বিক্রি করতে চাইনি। দত্তক দেওয়ার সঙ্গে কিছু অর্থ হাতে পেলে আমার বেঁচে থাকার পথটাও সুগম হতো।

অভাবের তাড়নায় শিশুসন্তানকে বাজারে নিয়ে ‘বিক্রির চেষ্টা’য় আলোচিত খাগড়াছড়ির সোনালী চাকমা তার ভাষায় অসংলগ্নভাবে এভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই ঘটনার। তিনি এখন তাঁর সন্তানকে নিয়ে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম পাকুজ্যাছড়িতে বাবার বাড়িতে আছেন। ওই ঘটনার পর তার পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাকে চাল-ডাল-তেলসহ কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন কেউ কেউ।

অসুস্থতার কারণে দুর্বল ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মাঝবয়সী সোনালী অনেকদিন ধরেই অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি তার ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের বাজারে যান। তার এলোমেলো ঘোরাফেরা দেখে পরিচিত একজন কথা বলে জানতে পারেন, সন্তানকে টাকার বিনিময়ে দত্তক দিতে চান তিনি। এই তথ্য ছড়িয়ে পড়তেই স্থানীয় এক বাঙালি দত্তক নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে জংলি টিলার লোকজন তাতে বাধ সাধেন। তাদের বক্তব্য, কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমার স্ত্রী রোজিনা চাকমা দীর্ঘদিন ধরে একটি ছেলেকে দত্তক নেওয়ার জন্য খুঁজছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার সোনালীকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করে মারতে উদ্যত হন।

খবর পেয়ে রোজিনা চাকমা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আর্জেন্ট চাকমাকে সঙ্গে নিয়ে মাছ বাজারে যান। রোজিনার স্বামী সুনীল জীবন চাকমাও উপস্থিত হন। তারা মা-ছেলেকে নিয়ে শহরের মধুপুর বাজার এলাকায় যান। পথে মৃগী রোগের প্রভাবে সোনালী জ্ঞান হারান। পরে ছেলেসহ তাকে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়।

এ বিষয়ে অনিমেষ চাকমা রিংকুসহ উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে গতকাল শনিবার কথা বললে তারা জানান, চাকমা সমাজে শিশু বিক্রির মতো জঘন্য ঘটনার কোনো নজির নেই। ঘটনাটি ভুলভাবে গণমাধ্যমে এসেছে। সরেজমিন পাকুজ্যাছড়িতে গিয়ে জানা যায়, সোনালী অনেকদিন ধরে শিশুটির ভরণপোষণের জন্য নির্ভরযোগ্য মানুষ খুঁজছিলেন। সোনালীর ছোটভাই ভরত চাকমা বলেন, আমার বড় বোন আসলে পাগল।

সোনালী দেড় বছর ধরে তার বাবার বাড়িতে ভাইদের আশ্রিত হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন। তার বাবা কালাবো চাকমা, মা কালাবি চাকমা, ভাইয়ের স্ত্রী তুংকী চাকমা ও মমতা ত্রিপুরা এবং মামি বীর রানী চাকমা জানান, বছর আটেক আগে চতুর্থবারের মতো পানছড়ির দুর্গম শনখোলা গ্রামের ওজা বুজ্যা নামে এক প্রবীণ বৈদ্যকে বিয়ে করেন সোনালী। সেই ঘরের একমাত্র সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমা।

সোনালী প্রথম বিয়েতে একক সংসার করতে পারলেও পরের তিনটি সংসারেই সতিন বা বিপত্নীক স্বামীই তার ভাগ্যে জুটেছে। প্রথম ঘরের সন্তানরা সচ্ছল হলেও কেউ তার দেখভাল করে না। ফলে তিনি আশপাশের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনাহুতভাবে গিয়ে সেখান থেকে আনা খাবার বা চাল-ডাল খেয়ে কোনো রকমে চলতেন। কখনও কখনও ভিক্ষাও করতেন।

ভাইয়ের স্ত্রী তুংকী বলেন, আমরা নিজেরাই ঠিকমতো চলতে পারি না। তাই তাকে ও তার ছেলেকে পালন করা কষ্টকর। ওই বাড়ির একপ্রান্তে দেখা যায়, সোনালীর জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর। একপাশে গরুর গোয়াল, আর অন্যপাশে সোনালীর রান্নার চুলা, শোয়ার খাট, লাকড়ি আর স্তূপাকার সংসারের অন্যান্য সামগ্রী।

নিজের শিশুসন্তানকে কেন বিক্রি করতে চাইলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অসংলগ্নভাবে সোনালী জানান, কোনো সংসারেই একটু শান্তি পাননি। নিজের পেটে ধরা সন্তানরাও তার দেখভাল করেন না। কোথাও একটু থাকার জায়গা পাচ্ছেন না। কাজকর্মও করতে পারেন না। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দত্তক নেওয়ার মানুষ খুঁজছিলেন।

ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমা জানান, খবর পেয়ে শুক্রবার দুপুরে নারী এমপি বাসন্তী চাকমা কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে সোনালীর বাবার বাড়িতে যান। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ৬০ কেজি চাল, দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল ও তিন পদের মসলাসহ কিছু নগদ টাকা দিয়েছেন।

মহিলা সংরক্ষিত আসনে এমপি বাসন্তী চাকমা জানান, অসুস্থতা ও আয় না থাকার কারণে সোনালী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাই ছোট্ট শিশুটিকে দত্তক দিতে চেয়েছিলেন। শিশুটিকে সরকারি শিশুসদনে দেওয়া যায় কিনা সেটি আমরা দেখব। একই সঙ্গে সোনালীকে একটি সরকারি ঘর বরাদ্দ দেওয়ার চেষ্টা করব।

Advertisement