Homeসব খবরজেলার খবরদেশে কাজুবাদামের আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে

দেশে কাজুবাদামের আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে

বছর চারেক আগে (২০১৯ সাল) দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন ছিল ৯৭২ মেট্রিক টন। বর্তমানে এটি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দুই হাজার টন ছাড়িয়েছে। দেশে একদিকে যেমন কাজুবাদামের আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে; অন্য দিকে চাহিদাও বাড়ছে। আগে শুধু বড় লোকের ঘরে কাজুবাদাম দেখা যেত। কিন্তু এখন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এবং সরকারি-বেসরকারি অফিসে চা-কফির পাশাপাশি আপ্যায়নে কাজুবাদাম জনপ্রিয় হচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের হাত ধরে কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু হলেও এখন সিটি গ্রুপ, বিএসআরএম, কাজী ফার্মসের মতো দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বাস্তবায়নাধীন (২০২১-২০২৫) ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প শুরুর পর থেকে কাজুবাদাম চাষে ব্যাপকতা শুরু হয়। ২১১ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ১১টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেও মূলত দেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে কাজুবাদাম বেশি চাষ হয়। বিশেষ করে বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি কাজুর বাগান রয়েছে।

কাজুবাদাম চাষি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা মালিক বা উদ্যোক্তারা বলছেন, বান্দরবানসহ পাহাড়ে কাজুবাদামের চাষাবাদ এলাকা বাড়ছে। উৎপাদনও বাড়ছে। দাম ভালো পাওয়ায় স্থানীয়দের পাশাপাশি অনেকেই লিজ নিয়ে পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষ করছেন। পাহাড়ের অনেক দুর্গম এলাকায় কাজুবাদাম চাষ হয়। সেখান থেকে কাজুবাদাম সংগ্রহ করে উদ্যোক্তাদের হাতে পৌঁছানোই চ্যালেঞ্জ। এক দিকে নিরাপত্তাহীনতা, অন্য দিকে যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় উদ্যোক্তারা ভেতরে যেতে চান না। এই সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা চাষিদের কাছ থেকে কাজুবাদাম কিনে সেটা আবার বেশি দামে উদ্যোক্তাদের কাছে বিক্রি করছেন। এতে চাষি যেমন ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, তেমন উদ্যোক্তারা বেশি দামে কেনার কারণে খরচ বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে পাহাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে কাজুবাদাম সংরক্ষণাগার করার দাবি উঠছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি কাজুবাদাম চাষ হয় বান্দরবানের দুর্গম এলাকা রুমা ও থানচিতে। কিন্তু বান্দরবানে কাজুবাদাম বছরব্যাপী সংরক্ষণের জন্য কোনো সংরক্ষণাগার নেই। বিশেষ করে কাজুবাদাম অধ্যুষিত রুমা ও থানচি এলাকা বা আশপাশে কোনো ধরনের সংরক্ষণাগার না থাকার কারণে প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট পরিমাণে কাজুবাদাম সংগ্রহ করতে পারে না। বাজারে বিভিন্ন ব্যক্তিগত পর্যায়ে (মধ্যস্বত্বভোগী) আড়তে চাষিরা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে কাঁচামাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশে যে কয়েকজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মাধ্যমে দেশে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু হয়েছে তাদের মধ্যে নীলফামারীর জ্যাকপট কেশোনাট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল আরিফুজ্জামান অন্যতম। তিনি বলেন, কাজুবাদাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাহাড়ের কৃষকরা রুট লেভেলে উৎপাদন করেন। কৃষকরা হারভেস্ট করার পর তা রাখার জায়গা নেই। সবচেয়ে বেশি বাদাম হয় রুমা ও থানচি এলাকায়। রুমা উপজেলার সদরঘাট এলাকায় (রুমা সদরে) এবং থানচি এলাকার থানচি বাজার বা বলিপাড়া বাজারে সংরক্ষণাগার বা হাব হলে ব্যবসায়ী এবং চাষি দুই পক্ষই উপকৃত হবো।

তিনি বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্যবসায়ীরা দুর্গম এলাকায় যেতে পারেন না। নানা প্রতিবন্ধকতা আছে। পাহাড়িদের সমস্যা হলো তাদের আগে টাকা দিতে হবে। কিংবা টাকা দিয়ে তারপর মাল (বাদাম) নিয়ে আসতে হবে। টাকা দিয়ে মাল কিনলাম, কিন্তু সেটা সঠিকভাবে নিয়ে আসতে পারা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। রাস্তায় নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া ধরেন, বাগান থেকে চাষিরা এক কেজি কাজুর দাম (কাঁচামাল) ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সেটি মধ্যস্বত্বভোগীরা কিনে নেন। তিন-চার হাত বদলের পর এটি আমাদের কাছে আসা পর্যন্ত ১১০-১২০ টাকা হয়ে যায়। যদি থানচি বা রুমা এলাকায় দু’টি সংরক্ষণাগার হয় তাহলে চাষিরা সরাসরি সেখানে কাজু আনবে। সেখান থেকে আমরা কিনে নিতে পারব। এতে তারাও লাভবান হবে, আমরাও কম দামে পাব। উৎপাদন খরচ কমার কারণে কম দামে কাজুবাদাম বিক্রি সম্ভব হবে।

কৃষিবিদরা বলছেন, দেশে কাজুবাদামের চাষ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চল ও উত্তরের জেলাগুলোতে। দেশে এ দু’টি পণ্যের চাহিদা তো রয়েছেই, বিদেশে রফতানির মাধ্যমেও ব্যাপক বাণিজ্যিক সফলতা আসতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে কাজুবাদামের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।

দেশের তিন পার্বত্য জেলায়, বিশেষ করে বান্দরবানে কাজুবাদামের ফলন সর্বাধিক; এর পর রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি। জানা যায়, কাজুবাদাম চাষে যে প্রকৃতির মাটি-তাপমাত্রা-বৃষ্টি ইত্যাদি প্রয়োজন, সেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে আমাদের পার্বত্যাঞ্চলে। বর্তমানে বিশ্বে বছরে ৩৫ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে আফ্রিকার দেশগুলোতে ১২ লাখ টন; ভারতে ৭ লাখ ৪৬ হাজার টন এবং ভিয়েতমানে ৪ লাখ টন প্রায়। বাংলাদেশে উৎপাদন হয় মাত্র ২ হাজার টনের মতো। দেশে ২০১৮ সালে কাজুবাদাম আমদানি করা হয় ৩৩০ টন; ২০১৯ সালে ৫১০ টন; ২০২০ সালে ১৬২৪ দশমিক ৭৭ টন, ২০২১ সালে ২০৩০ দশমিক ৫৩ টন, ২০২২ সালে ১৮৫৮ দশমিক ৫৬ টন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ৪৩১ দশমিক ৭৮ টন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ও বিদেশে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে গত কয়েক বছরে দেশে বেশ কিছু কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে এ খাতে এক দিকে যেমন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে তেমনি নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আবাদ এবং প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তোলা গেলে রফতানি আয়েও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কাজুবাদাম চাষ হতো ১৮০০ হেক্টর জমিতে, এখন হচ্ছে ৩৫০০ হেক্টর জমিতে।

‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের ডিপিপিতে কাজুবাদাম সংরক্ষণাগারের বিষয়টি নেই। বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবি উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করব।-নয়া দিগন্ত।

Advertisement