Homeঅন্যান্যচলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ

চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ

চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ চলছে। প্রতি বছর মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা মূলত আয়োজকের দায়িত্ব পালন করে থাকে। অর্থের জোগান আসে তাদের করা মুখোশ, সরা, এবং শিল্পী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি বিক্রি করে। কোনো পরনির্ভরশীলতা এখানে নেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যতিক্রম যা, তা হলো দুটি উৎসব একসাথে পালিত হচ্ছে। ঈদ ও পয়লা বৈশাখ এক-দুদিন আগে-পিছে তারিখে এসে মিলেছে। আবার ঈদ পালিত হবে এক মাস রোজা পালন শেষে। আর বৈশাখের প্রস্তুতিও এক মাস ধরেই প্রতিবছর চলে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ঈদ কি বৈশাখের প্রস্তুতিকে ম্লান করেছে কিনা?

প্রথম মুখস্থ বিষয় হলো–বাঙালি উৎসবপ্রবণ; উপলক্ষ এখানে গৌণ। আপনি একটি খালি রাস্তায় বা মাঠে দাঁড়িয়ে যদি কিছুক্ষণ একটা কিছু খোঁজার ভঙ্গি করেন, দেখবেন আধ ঘণ্টার মধ্যে লোক জমে গেছে। কেউ জানে না কেন, কিন্তু উৎসুক চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সকেও এই জনতা আর পথ করে দেবে না সহজে। তাই আমাদের উৎসবের প্রকরণ নিয়ে কথা বলার সময়, আপনি যখন বুঝতে চান কোন উৎসবটি কীভাবে পালিত হচ্ছে, কোথায় ভিড় বেশি, তাহলে দেখতে হবে কে মাঠের কেন্দ্রে আছে।

দ্বিতীয় বিষয় হলো, নগরে বৈশাখ পালিত হয় উদ্বাস্তু মানুষদের অংশগ্রহণে। যারা গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন কাজের সূত্রে, গ্রামে যাপন করার অভ্যাস ভুলেছেন কিন্তু মনের কোণে গ্রাম নানা কারণে উঁকি দেয়, তাদের অংশগ্রহণে নতুন উৎসবের যে সকল প্রকরণ তৈরি হয়েছে, পয়লা বৈশাখ তার একটি। এই নাগরিকদের আয়ের সাথে গ্রামের কোনো সম্পর্ক নেই, তাই শহরে তাদের আনন্দ আয়োজন।

আর ঈদ হলো এমন একটি ধর্মীয় উৎসব, যা জন্মসূত্রে পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া। ফলে ঈদ মানে কাজে ফেরা নয়, বরং কাজ থেকে পরিবারের কাছে ফেরা। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো জায়গা নেই। এর উত্তর খোঁজার জন্য অন্যের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের দিকে তাকালেই চলে। তাই একটি-আরেকটির প্রতিপক্ষ নয়, বরং বাস্তবতা পাঠের একটি সূচক। যে সূচকে দেখা যাচ্ছে ঈদের ছুটির কারণে ঢাকা শহর খালি হয়ে যাচ্ছে। এই খালি হওয়া বলে দিচ্ছে, ঢাকা নগর ডায়াস্পোরিক সংস্কৃতির ধারক। তার আপনজন তৈরি হয়নি। একটা বন্দর নগরীর মতো তার চরিত্র। অনেক ভিড়, কিন্তু কেবল যাওয়া-আসা। এখানে খুব বেশি মানুষ স্থায়ী হয়নি এখনো। এবং এআই যুগের তোপের মুখে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশ এখনো পরিবার কাঠামোর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রাম বা শহর সব জায়গাতেই।

গ্রামে অনেক জায়গায় ধান রোপন হয় পৌষ মাসে। ফলে বৈশাখে ঘরে নতুন ধান আসছে এবং তার বৈশাখ, তথা নতুন বছরের গল্প ঈদের সাথে কোনো সংঘর্ষ তৈরি করেনি। আবার অনেকের ক্ষেতে এখন সবে ধানের শীষ ছেড়েছে। ধান উঠবে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যে। এই যে ক্ষেতে অপেক্ষমাণ ধান এবং ঘরে এসেছে ঈদ, আপনাদের কি মনে হয় তার ঈদ পালনের আর্থিক সক্ষমতা সবার আছে? সেই কৃষাণী-কৃষকের অসচ্ছ্বলতা, শিশুদের নতুন জামা-কাপড় পাওয়ার কৃচ্ছতা, সালামি দিতে না পারা–একটা টানাপোড়েন তৈরি করবে না? জৈষ্ঠ্যে আম, কাঁঠাল আর নতুন ধান যখন ঘরে উঠবে, তখন আপনি তার মনের উৎসব কি কোনো পরিসংখ্যানে আটকে রাখতে পারবেন?

বৈশাখ উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত একটি উৎসব। শুধু সম্ভাবনা নয়, বরং প্রাপ্তির আনন্দকে উদ্‌যাপন করার উৎসব। এই উৎসব ঘরে ঘরে, ঘর থেকে পাড়ায় পাড়ায়, এবং এভাবে সবার। কৃষির ক্ষয়ের সাথে সাথে গ্রামেও এ উৎসবের রূপ বদলে যাচ্ছে না—বরং বলা যায় প্রয়োজনই থাকছে না। শহরের কর্মক্ষেত্র নিরেট; প্যাকেজিং ছাড়া পণ্যের মতো। ছন্নছাড়া বেতনভোগী কর্মচারী জীবন ও সংস্কৃতিও যেন তাই। তার হাতে যেভাবে টাকা আসে, তা উদ্‌যাপনের মধ্যে কোনো কমিউনিটি বোধ নেই। ফলে দেশ তথা নিজের পরিচয়ের পরিসর ছেড়ে এই দীর্ঘ প্রবাসে, একটি রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে একটা কমিউনিটি বোধ তৈরি করে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো উৎসব। এই উৎসবে অংশগ্রহণ অবশ্য পালনীয় নয়, বরং উৎসববিহীন কর্মক্ষেত্র থেকে একটু অবসর খোঁজার সুযোগ করে দেয় মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো আয়োজন। তাই যখন পরিবারের কাছে ফেরার সুযোগ থাকে না, যখন কেবল কাজ আর কাজ, যখন আপনজনের সাথে দেখা হয় না, একাকিত্বই সঙ্গী, তখন মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢল নামে কাজ থেকে ছুটি পাওয়ার বা নেওয়ার নানা অজুহাতের উপায়ে। একটা দিন পোশাকে, আচরণে একরকম উদ্‌যাপন করার মধ্য দিয়ে নগরের শ্রমিকদের মধ্যে একটা কমিউনিটি বোধ তৈরি হয়, স্মৃতি রোমন্থন হয় এবং আংশিকভাবে পরিবারের সাথে উদ্‌যাপিত হয় ক্ষণগুলো।

এ বছর বৈশাখের আগে ঈদ এল মানে, একটা দিনের কতকগুলে ক্ষণ মাত্র নয়, বেশ কয়েকটা দিন পুরো পরিবারের সাথে উদ্‌যাপনের সুযোগ তৈরি হলো। মানুষ তবে কোনটি নেবে? আসলে সবটাই নেবে, কারণ কাজের অবসরে তার চাই একটু অবসর, একটু আনন্দ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রাচ্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement