Homeঅন্যান্যরাখাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র শিপন

রাখাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র শিপন

পাবনার বেড়া উপজেলার চর রোরামারা গ্রামের স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া ছাত্র ছিল শিপন ওরফে মুস্তাকিম হোসেন। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর লেখাপড়া বাদ দিয়ে দু’বছর তিনি এক গেরস্তের বাড়িতে ‘রাখাল’র কাজ করছিলেন। শিপনকে ডেকে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন তারই বাল্যশিক্ষক ফেরদৌস আলম তপন। শিপন স্কুলে পড়ার সময় সপ্তাহের অর্ধেক দিন নগরবাড়ী ঘাটে কুলির কাজ করতেন। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

মুস্তাকিম হোসেন শিপনের বাবার নাম আশরাফুল মোল্লা এবং মায়ের নাম শান্তি বেগম। যমুনার পাড়ে চর বোরামারা গ্রামে তাদের বাড়ি। বাবা এখনো অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ২য়। পরিবারে আর কেউ লেখাপড়া করতে পারেনি।

রোরামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফেরদৌস আলম তপন জানান, তাদের স্কুল থেকে চরের অন্যান্য অনেক ছাত্রর সঙ্গে শিপনও ঝড়ে যায়। তার কথা সবাই ভুলেও যান। ২০১৩ সালের কোনো একদিন তিনি দেখেন স্কুলমাঠে প্রায় ১১ বছরের একটা ছেলে এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। তিনি এগিয়ে শিশুটিকে কাছে ডাকতেই বলল- ‘স্যার আমাকে এক প্যাকেট বিস্কুট দেবেন?’ তখন স্কুলে ফিডিং প্রজেক্টের আওতায় বিস্কুট দেওয়া হত।

শিক্ষক ফেরদৌস আলম তপন এক প্যাকেট বিস্কুট তার হাতে দেন। এ সময় তিনি বলেছিলেন- ‘তুমি স্কুলে আসবে? শিশু শিপন তখন জানায়, সে দু’বছর আগে লেখাপাড়া বাদ দিয়েছে। এখন গেরস্ত বাড়িতে রাখাল হিসেবে কাজ করছে। সে স্কুলে আসতে ইচ্ছুক।

শিক্ষক ফেরদৌস আলম তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে তাকে আবার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে নেন। বয়সের কারণেই তাকে আবার দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়নি।

সেসময় একটি শর্ত দিয়েছিলেন শিপন। বলেছিলেন, তিনি তিনদিন স্কুল করবেন আর তিনদিন তাকে ছাড় দিতে হবে। কারণ ঐ তিনদিন তিনি নগরবাড়ী ঘাটে সারের বস্তা টানবেন। কারণ তার আয়ের টাকা বাড়িতে দিতে হতো। আর সামান্য কিছু টাকা নিজের পড়াশোনার জন্য ব্যয় করতেন। নগরবাড়ী ঘাটে সবচেয়ে কম বয়সী কুলি ছিলেন শিপন। স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাসে বসে থাকতেন না শিপন। মাঠে গিয়ে একা একা ফুটবল খেলতেন। তবে শিক্ষকরা তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ঠিকই।

শিক্ষক তপন বলেন, ‘এসব দেখেও তাকে কিছুই বলতাম না। আমি ভাবলাম, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত সে কী করে? কিছুদিন যাওয়ার দেখা গেল সে আর খেলছে না। অন্যদের দেখাদেখি সেও পড়শোনা করতে থাকল। এমনকী তার সহপাঠীরা যখন খেলাধুলা করতো তখন সে ক্লাসে বসে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।’

তিনি আরো বলেন, ‘ওর ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন শিক্ষকরা। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার আগে সব শিক্ষকই তার পাঠোন্নতির বিষয়টি খেয়াল করলেন। শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেল। সবাই ফাইনালে দিকে তাকিয়ে থাকলেন।’

‘ফাইনাল পরীক্ষায় সে খুব ভালো করলো। লেখাপড়া বাদ দিয়ে সে দু’বছর রাখালি করেছে। এরপর দুই ক্লাস ডিঙিয়ে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়ে তার ভালো করা দেখে সব শিক্ষক অভিভূত হলেন। ক্লাস ফাইভে এসে সে আরো সিরিয়াস হয়ে গেল। তার বাড়িতে জায়গা না থাকায় বাড়ির কাছে এক ব্যক্তির একটি ছাপরা ঘরের মধ্যে কাঁথা বিছিয়ে সে থাকত এবং পড়াশোনা করতো। প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেল মোস্তাকিম শিপন’, যোগ করেন সহকারী শিক্ষক ফেরদৌস আলম তপন।

এরপর শিক্ষক তপনের পরামর্শে নগরবাড়ী ঘাটের পাশে হরিনাথপুর এসইএসডিপি মডেল হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন শিপন। সেখানে ভর্তি হওয়ার কারণ ছিল যেন তিনি নগরবাড়ী ঘাটে সহজেই কুলির কাজটি করতে পারেন। সেখানেও একইভাবে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।

সপ্তাহে তিনদিন স্কুলে না গিয়ে ঘাটে কুলি হিসেবে কাজ করতেন। তা সত্ত্বেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভালো ফল করে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু দ্রুত হাইস্কুল জীবন শেষ করার জন্য তাকে এক ক্লাস ডিঙিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়।

হাইস্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি ঘাটে বস্তা টানার কাজ করতেন অদম্য শিপন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে গোল্ডেন এ প্লাস পান। এ সময় স্কুল থেকে লটারি করে ক্লাসের রোল নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে শিপনের রোল নম্বর হয় ১।

ক্লাস নাইনের ‘ফার্স্ট বয়’ নগরবাড়ী ঘাটে সপ্তাহের অর্ধেক দিন কুলির কাজ করতেন। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া দূরে বলে ঐ স্কুলেই থাকতেন। অন্যকিছু সহপাঠী স্কুলে থাকতো। তারা রাতে কোচিং করত। শিপনও তার আয়ের টাকায় রাতে কোচিং করতেন।

শিক্ষক ফেরদৌস তপন জানান, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন শিপন সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রাত জেগে পড়াশোনা করে। তিনি তার জন্য মাঝে মধ্যেই স্কুল ফিডিংয়ের উন্নতমানের বিস্কুট পাঠিয়ে দিতেন।

এভাবে ঘাটে শ্রমিকের কাজ আর রাত জেগে পড়াশোনা করার পর ২০১৮ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পান শিপন। তারপর ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। সেই শিপন এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র।

জানতে চাইলে মোস্তাকিম শিপন বলেন, ‘তপন স্যারের জন্যই আজ আমি রাখালি জীবন ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরেছি। এজন্য আমি স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

সহকারী শিক্ষক ফেরদৌস তপন বলেন, ‘ঝরে পড়া শিপনকে তুলে আনতে পারা আমার শিক্ষকতা জীবনের একটি বড় পাওয়া। শিপন ধীরে ধীরে তার স্বপ্ন পূরণ করতে শুরু করেছে। তার স্বপ্ন পূরণ হলেই আমার শিক্ষকতা জীবন সার্থক হবে।’

শিপনের বাবা আশরাফুল মোল্লা বলেন, ‘বোরামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। সেখানে শুরুর দিকে ছেলে লেখাপড়া করতে চাইতো না। আবার আমারও আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তাই তখন আমাদের গ্রামের বক্কার মাতবরের (আবু বকর মেম্বর) বাড়িতে ছেলেকে রাখাল রেখেছিলাম। তখন তপন স্যার ছেলেকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এরপর সে নিজে কাজ করে টাকা উপার্জন করে সেই টাকায় লেখাপড়া করতে থাকে। সে নিজের উপার্জনের টাকাতেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।’

শিক্ষক ফেরদৌস তপন বলেন, ‘ঝড়ে পড়া শিপনকে তুলে আনতে পারা আমার শিক্ষকতা জীবনের একটি বড় পাওয়া। শিপন ধীরে ধীরে তার স্বপ্ন পূরণ করতে শুরু করেছে। তার স্বপ্ন পূরণ হলেই আমার শিক্ষকতা জীবন সার্থক হবে। একজন রাখাল বালকের ভেতরে এত প্রতিভা এত সংগ্রামী চেতনা লুকিয়ে আছে সেদিন বুঝিনি। সে একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে তার দ্বারাও অনেক অসহায় উপকৃত হবে।’

সূত্র: ডেইলি-বাংলাদেশ।

Advertisement