Homeসব খবরজেলার খবরবিদেশে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের ঝাড়ু

বিদেশে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের ঝাড়ু

ঘরদোর পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করার কাজে জুড়ি নেই ফুলঝাড়ুর। সে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ফুটে ভিন্নধর্মী ঝাড়ফুল। আর সেই ফুল সংগ্রহ ও ঝাড়ু বানিয়ে বিক্রি করে পরিবার চালাচ্ছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাজারো মানুষ। অনেকের জীবিকা হয়ে উঠেছে ফুলঝাড়ু উৎপাদন ও বিক্রি। এ ফুলঝাড়ু দরিদ্র মানুষের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হয়ে উঠেছে, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ফুলঝাড়ু শ্রমজীবী মানুষকে এনে দিয়েছে কর্মসংস্থান। আর এ ঝাড়ু এখন স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তসহ বিদেশেও।

এতে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলা এই ফুলঝাড়ু সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের নেই কোনো পরিসংখ্যান, তবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ আর পরিচর্যা করা গেলে এ ফুলঝাড়ু অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে এ প্রাকৃতিক সম্পদটি- বলে জানান ঢাকা বিভাগের বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন।

বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে কেরানীগঞ্জের আগানগর কেচি শাহ ডর্কইয়ার্ড এলাকায় সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঝাড়ু উৎপাদন কারখানা ও ছোট-বড় অর্ধশতাধিক দোকানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ঝাড়ুপল্লি। এদিকে, বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি-এপ্রিল বান্দরবনের বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকা থেকে স্থানীয় নারী ও পুরুষরা এ ঝাড়ফুল সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসে বিক্রির উদ্দেশ্যে। জুমে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার কৃষি পণ্যের সঙ্গে এই ঝাড়ফুল হয়ে ওঠেছে তাদের বাড়তি উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। এদিকে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এই ঝাড়ফুলের ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষজন।

ঝাড়ফুল পাইকার ব্যবসায়ী সাইফুল সিকদার বলেন, আমরা বছরে দু’বার এ ঝাড়ফুলের ব্যবসা করে থাকি। এই ব্যবসা করে আমাদের সংসার বেশ ভালো চলে। আমরা প্রথমে পাহাড় থেকে বিভিন্নজনের কাছ থেকে এই ঝাড়ফুল সংগ্রহ করি, তারপর সব এক জায়গায় সংগ্রহ করে শুকিয়ে আটি বেঁধে ট্রাকে করে কেরানীগঞ্জের আগানগর ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করি। এক ট্রাক ঝাড়ফুল বিক্রি করে আমাদের প্রায় ২০ হাজার টাকা লাভ হয়। ঝাড়ু বানানোর কারিগর আলমগীর হোসেন বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে আমিসহ আরও তিন কর্মচারী ঝাড়ু তৈরির কাজ করছি। আগে আমি একা কাজ করতাম। এখন একটি বড় ঘর ভাড়া নিয়েছি। এখানে ঝাড়ু তৈরি করে বিক্রি করছি।

কারিগর আলমগীর আরো বলেন, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙামাটিসহ পাহাড়ি এলাকা থেকে ঝাড়ফুল কিনে আনেন তারা। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারত থেকে ঝাড়ফুল আমদানি করা হয়। আর শলা আনা হয় বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে। আরেক ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, কারখানাগুলোতে শলা ও ফুলের ঝাড়ু তিন ধরনের হয় : ভিআইপি, উন্নত ও সাধারণ মানের। ভিআইপি শলার ঝাড়ু পাইকারি দরে ১০০টির দাম ১০ হাজার টাকা, একই মানের ফুলের ঝাড়ু ১০০টির দাম ১৪ হাজার টাকা। উন্নত মানের শলার ১০০টি ঝাড়ুর দাম ৮ হাজার টাকা, এই মানের ফুলের ঝাড়ুর ১০০টির দাম ১০ হাজার টাকা। আর সাধারণ মানের শলার ১০০টি ঝাড়ুর দাম ৪ হাজার টাকা, ফুলের ঝাড়ুর দাম ৬ হাজার টাকা। তিনি জানান, ঝাড়ুশ্রমিকেরা ফুলের ঝাড়ু বানালে প্রতিটিতে পাঁচ টাকা এবং শলার ঝাড়ুর বানালে তিন টাকা করে পান।

খাদেজা ট্রেডার্সের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ২০ বছর ধরে ঝাড়ুর ব্যবসা করছি। দরপত্রের মাধ্যম ঢাকা সিটি করেপারেশনসহ পৌরসভাগুলোতে পাইকারি দরে ফুল ও শলার ঝাড়ু বিক্রি করি। মাঝেমধ্যে দুবাই, ইউরোপ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি করি। দিনদিন ঝাড়ুর চাহিদা বাড়ছে। পাইকারেরা একসঙ্গে ৫০ থেকে ৭০ হাজার ঝাড়ু কিনে নিয়ে যান। ফাইভ স্টার ট্রেডার্সের পরিচালক আলআমিন বলেন, আমাদের এখানে তৈরি করা ঝাড়ু গুণগত মানের। বছরখানেক ধরে শীত মৌসুমে ইউরোপ, আমেরিকা, লন্ডন, দুবাই, কাতার থেকে লোকজন এখানে এসে পাইকারি দরে ঝাড়ু কিনে নিয়ে যায়। এগুলো সেসব দেশের সুপারশপ, দোকান ও মার্কেটে বিক্রি করা হয়ে থাকে। শীত মৌসুমে আমাদের বেচাকেনা ভালো জমে। এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ডালিম মিয়া বলেন, প্রতিবছরই আমরা এই দুই-তিন মাস ফুলঝাড়ুর কাজে জড়িত হই। সপ্তাহে ৪ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। এই মৌসুমটা আমাদের জন্য অত্যন্ত ভালো, কেননা এই দুই-তিন মাস (জানুয়ারি-এপ্রিল) আমাদের প্রতিদিনই কাজ করতে হয়, আর টাকাও ভালো পাওয়া যায়।

বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, এ শুকনো মৌসুমে বান্দরবানে ঝাড়ফুলের দেখা মেলে। প্রাকৃতিগতভাবে এ ঝাড়ফুল উৎপাদিত হয় বান্দরবানে। তিনি বলেন, বান্দরবান থেকে এ ঝাড়ু পরিবহন করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। আর এই পরিবহনের অনুমতি জন্য সরকারিভাবে আমরা রাজস্বগ্রহণ করে থাকি। এ বন কর্মকর্তা আরো বলেন, পাহাড়ের ঝাড়ফুল সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের কোন ব্যবস্থা নেই। সরকারীভাবে সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিলে এটি একদিন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ শাখার সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর আগানগর কেচি শাহ ডক এলাকায় ঝাড়ুর অল্পকিছু দোকান ছিল। এখন দোকানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ঝাড়ুপল্লির বানানো ঝাড়ু রপ্তানিও হচ্ছে। এতে একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।

সূত্র: সময়ের কণ্ঠস্বর।

Advertisement