Homeসব খবরজাতীয়বজ্রপাতে হতাহত বাড়ছেই

বজ্রপাতে হতাহত বাড়ছেই

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে চললেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েই দায় সেরেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে দেশবাসীকে বজ্রপাতের আগাম সতর্ক বার্তা দিতে দেশের ৭২৩টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করার কথা থাকলেও মাত্র ৮টি স্থানে এটি বসিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। যাতে খরচ হয়েছিল ২০ কোটি টাকা।

কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেগুলোও অচল হয়ে পড়ে। এছাড়া হাওর এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক ও কৃষকের অবস্থানের জন্য শেল্টার নির্মাণের কথা থাকলেও সে কাজ আর এগোয়নি। ফলে বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণ কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কমানোর বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে বজ্রপাতে প্রাণহানি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়লেও প্রতিবছর বজ্রপাতে ঠিক কি পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছে; তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। কেননা সে ধরনের প্রযুক্তিগত কোনো উপায় বাংলাদেশে নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে (২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত) বজ্রপাতের ঘটনায় ২ হাজার ৪শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে মারা গেছে ১৮শ’ মানুষ। গত বছরে মারা গেছে ২৩৯ জন মানুষ। অবশ্য বেসরকারি হিসেবে এ মৃত্যুর সংখ্যা ৩৮২ জন। গত এক মাসেই (মে) মারা গেছে ৮১ জন মানুষ। যেকারণে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে সারা দেশে ১৯৮ জন মানুষ মারা গেছে। আর বেসরকারি হিসাবে ৩৬০ জন। আহত হয়েছে ১৭৯ জন। ২০১৭ সালে সারা দেশে বজ্রপাতে ৩৩৭ জন মানুষ মারা যায়। বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হাওর অঞ্চলে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৯, সিলেট জেলায় ২৬, নেত্রকোণায় ১৮ ও দিনাজপুরে ৮ জন মারা যায়। এছাড়া বজ্রপাতে বহুসংখ্যক গবাদি পশুরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ৩১ মার্চ কালবৈশাখী ঝড়, শীলা বৃষ্টি ও বজ্রপাতে একদিনে দেশের আট জেলায় মৃত্যুবরণ করেছে ১২ জন, আহত হয়েছে ৫৭ জন।

দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১৩ সালে ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে মারা যায় ২০১ জন। ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম ১৭৯। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৪৬। ওই বছরের মে মাসেই ১২০ জন প্রাণ হারায়। এছাড়া এপ্রিলে ৫৫ ও জুনে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে ৩৩ জন। ২০১৫ সালের ২-৩ মে ১৯ জন। ২০১৬ সালে শিশু ৭৯ জন, মহিলা ৫১ জন এবং পুরুষ ২২০ জন মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭ সালে বজ্রপাতে শিশু ৫২ জন, মহিলা ৪৩ এবং পুরুষ ২০০ জন মৃত্যুবরণ করে।

সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এসএমআরসি) বজ্রপাতের ওপর ২০০৯ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সার্ক স্টর্ম প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্পের অধীনে এ গবেষণা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় বজ্রপাতে এখানে মৃতের হার বেশি।

সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করে এক থেকে দেড় হাজার মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের।

এদিকে মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা সম্প্রতি জানিয়েছে, বাংলাদেশের শেরপুর, নরসিংদী ও পাবনায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। এছাড়াও প্রতিবছর বজ্রপাত প্রবন এলাকা বাড়ছে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে আগাম সতর্ক বার্তা দিতে দেশের আটটি স্থানে পরীক্ষামূলক লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। যাতে খরচ হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেগুলো অচল হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, বজ্রপাত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো অন্যসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের যে উদ্যোগ থাকে এক্ষেত্রে তা নেয়া হয়নি। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এটি প্রতিকারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলেই মনে করেন তিনি।

Advertisement