Homeসব খবরজেলার খবরফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা ঋণগ্রস্ত ফ্রিল্যান্সারের

ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা ঋণগ্রস্ত ফ্রিল্যান্সারের

রাজশাহীতে ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে আনারুল ইসলাম টুটুল (৩২) নামের এক ফ্রিল্যান্সার গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় ঋণগ্রস্ত ও পাওনা টাকা না পেয়ে হতাশায় তিনি এই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে জানা গেছে।

মঙ্গলবার বেলা ১১টায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃত টুটুল নগরীর হোসেনীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।অত্যন্ত অমায়িক ও শান্ত মেজাজের এই ফ্রিল্যান্সারের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মণ সাংবাদিকদের জানান, ‘সোমবার দিবাগত রাত ৩টার পরে যেকোনো সময় তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি যেহেতু সারারাত জেগে সকালে ঘুমান তাই বাড়ির লোকজনের জানতে দেরি হওয়ায় আমাদের জানতেও দেরি হয়েছে। বাসার লোকজনই বেলা ১১টার দিকে জানতে পেরে পুলিশকে খবর দেন। তার তিন ছেলেমেয়ে রয়েছে। তিনি অনেক ঋণগ্রস্ত ছিলেন বলে পরিবার জানিয়েছে।’

ওসি বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগে সোমবার রাত ১১টা ১৩ মিনিটে আনারুল ইসলাম তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাসে জানান, তিনি ফ্রিল্যান্সিং করে অনেক টাকা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অসুস্থতার কারণে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিছুটা সুস্থ হলে আবার তিনি ফ্রিল্যাসিং শুরু করেন। তিন মাস যেতে না যেতেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এজন্য তাকে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণগ্রস্ত থাকায় তার পরিবারে ব্যাপক অভাব-অনটন দেখা দেয়। এছাড়া স্ট্যাটাসে উল্লিখিত আইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা ১৭ লাখ টাকা না পাওয়ায় হতাশাবোধও তৈরি হয়। এসব কারণেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন তিনি।’

ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘মৃত ফ্রিল্যান্সারের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই ফ্রিল্যান্সার নিজের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করেছেন। এতে তুলে ধরেছেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ব্যবসায়িক নানা তথ্য। পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম।
আমার পোস্টটি অবশ্যই পড়বেন।
আমি মোঃ আনারুল ইসলাম টুটুলল।
আমি অসুস্থ থাকা অবস্থায় অনেকে এ আমাকে সাহায্য করেছিলেন। আমি একটু সুস্থ হবার পরে মনে করলাম জীবন এ তো অনেক কষ্ট করেছি একটু ছেলে/মেয়ে কে সুখ দেবার চেষ্টা করি তাই নেমে পড়লাম জীবন যুদ্ধে, কারণ আমি জানি বসে থেকে খেলে রাজার ভান্ডার এক সময় শেষ হইয়া যাবে। আমি যেহেতু অসুস্থ সেই জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে কয়টা কম্পিউটার কিনে কাজ শুরু করে দিলাম। ২/৩ মাস ভালোই গেলো, শুরু হলো আবার আমার শরীর খারাপ, অনেক ইনভেস্ট অনেক লস। কোনো ভাবেই সব ঠিক করতে পারছি না। আমার ছোট মেয়ে রুকু মনি ৫ওয়াক্ত নামাজ পরে ওর প্যান্ট ছিড়ে গেছে।

ওর আম্মু কে বলছে আম্মু সব গুলান সেলাই করে দাও, আমার বউটা ছেড়া জামা, ছেড়া বোরখা পরে বেড়াচ্ছে, এই গুলান দেখে কি করে সহ্য করি আমি। ওরা কিছু চাওয়ার আগেই তো আমি হাজির করে দিয়েছি। যত দিন থেকে এই অনলাইন জগতে এসেছি একটা রাত আরামে ঘুমাতে পারিনি, শুধু টেনশন আর টেনশন লক্ষ্য লক্ষ টাকার জিমেইল ইডু মেইল ডিসেবল। তবু আমিও সব ঠিক করে নিতে পারতাম, কাজ জানি কিন্তু মানুষ আমাকে চিটার বাটপার ভাবতে পারে। কাকে বলবো আমার দুঃখের কথা কাওকে তো পাশে পাবোনা। আমি মানসিক ভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত।

আমি রেক্স আইটির আব্দুস সালাম পলাশ এর কাছে ১৭ লক্ষ্য টাকা পাবো। আমার ব্যাচ নম্বর ১৬৬ । পলাশ কে কয়দিন আগে সি-আইডি ধরেছে। এই পলাশের জন্য হাজারো পরিবার শেষ হয়ে গেছে, কয়েক হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। সকল রেক্সার ভাই যারা যারা আমাকে চেনেন আমার পরিবার এর পাশে থাকবেন। আর আপনাদের এই হতভাগা টুটুল ভাইকে ক্ষমা করে দিবেন।

আমার স্ত্রীকে কেউ দোষারোপ করবেন না, সে আমার কিছুই জানে না, কারণ সে আমাকে সব থেকে বেশি বিশ্বাস করে। ওর ওসব টাকা পয়সা আমাকে দিয়ে দিয়েছে। আমি কোনো সময় আমার কাজের বিষয় এ ওর সাথে কোনো কিছু শেয়ার করিনা, চিন্তা করবে, আমাকে সুস্থ করার জন্য এক সময় ওর সব গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলো। শুধু একটা কথা বলতো তুমি সুস্থ হও আবার বানিয়ে দিবা। আমার স্ত্রী অনেক সাদা-সিদে মানুষ বেশি কিছু বুঝে না। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে আর এই জন্য এত কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছে সে। গত ২ মাস ধরে সারাদিন কাজ কাম করে/দোয়া কালিমা পড়ে, আমল করে/রোজা থাকছে আবার রাতে তাহাজ্জুত নামাজ পড়ে শুধু আমার জন্য এত কষ্ট করছে, আমি ওর কষ্ট গুলান আর দেখতে পারছি না। সব থেকে ভালো সহধর্মীনি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, আমি তার যোগ্য না। তার কথা মতো চললে আজ আমার এমন দিন আস্ত না। তাই নিজেই নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।

=রুবি- টুম্পা – নাফিস – রুকু তোমার আমার জান গো।

তোমরা আমাকে মাফ করে দিও গো। আমি অনেক চেষ্টা করলাম কোনো ভাবেই কিছু করতে পারছি না, অনলাইন জগতে কেও কাওকে হেল্প করতে চাইনা, অনেক চেষ্টা করলাম বেঁচে থাকার জন্য কিন্তু পারলাম না। কোনো ভাবেই কাজ হচ্ছে না। আমি বেঁচে থাকলে আরো ঋণ বেড়ে যাবে তার থেকে আমি চলে যাই।

সাদীপ ভাই আমার,
নাফিস/রুকু টুম্পাকে দেখে রেখো কখনো ধমক দিয়ে কথা বলিও না ওরা কষ্ট পাবে, মনে হবে আব্বু নাই তাই এমন করছে। দীপ ভাই আমার বুজতে দিও না ওদের আব্বু আর নাই। আমি বাড়িতে থাকতে তোমাকে সব কথায় বলতাম। আমি অনেক বার গেছি তোমাকে সব বলবো ভেবে কিন্তু পারিনি বলতে। ভাই মাটি দিতে তারা হুর করিও না, আমার সকল আত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশীসহ দেশের অনেক ভাই বোন আছে যারা আমাকে অনেক ভালোবাসে তাদের দেখার সুযোগ দিও।

=বড় আব্বা, বড় মা আপনারা।
আমার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের দেখে রাখবেন।

বড় আব্বা, বড় মা, আমার তো মা/বাবা নাই আমি ছোট থেকেই আপনাদের নিজের বাবা মা জানি। এই কয়দিন অনেক বার বাড়িতে গেছি এক বার মনে করেছিলাম আপনাদের সব বলি, যে আমি অনেক বিপদে আছি। কিন্তু যদি পাশে নাই পাই কাওকে।

=হারুন ভাই, ভাগ্যবান তো সেই ভাই/বোন যারা আপনার মতন একজন ভাই পেয়েছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমার ছেলে মেয়ের ঈদ এর পোষাক কিনে দিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে ভাই কেমন বাপ আমি ছেলে মেয়েকে পোশাক কিনে দিতে পারিনা ঠিক মতন খাবার দিতে পারিনা, কেমন স্বামী আমি বউ কে একটা জামা কিনে দিতে পারিনা, রুবি বার বার বলছে ভাইয়া কে বললে মনে হয় আমাকেও কিনে দিতো। আমি বুজলাম ওর ভিতরে অনেক কষ্ট।

হারুন ভাইয়া রুবি সারাটা জীবন কষ্ট করেছে তাকে একটু দেখে রেখেন ভাইয়া। মেয়েটার ভিতরে অনেক কষ্ট দুঃখ এত গুলান ভাই থাকতেও কেও খোঁজ নেই না আপনি ছাড়া। আমার শেষ অনুরোধ টা রাখবেন ছোট বোনটার পাশে থাকবেন। আর ওর সব ভাইদের সাথে মিল করিয়ে দিবেন। ভাইয়া সম্ভব হলে রুকু মনি কে নিজের মেয়ের মতো করে লালন পালন করবেন। আপনি আমার নিজের ভাই হলে হয়তো আমি এই বিপদ থেকে বেঁচে যেতাম যদি আবার আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠায় আপনার ভাই হইয়া আসবো।

=দাদি-আম্মা-ছন্দা-মাসুমা -সুরভী-খেলনা আপা -শিহাব-রাব্বি-আসমা আপা -বড় ফুপু -মেজে ফুপু -ছোট ফুপু -সহ আমার সকল আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। যদি সম্ভব হয় আমার পরিবার এর পাশে থাকবেন।

=আসাদ ভাই আপনি অনেক বড় মনের একজন ভালো মানুষ যদি পারেন আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আপনার বাসায় যে দিন ভাড়া এসেছিলাম আপনাকে একজন অভিভাবক এর মতন পাশে পেয়েছি।

যারা আত্মহত্যা করে তারা নিজেকে একবার খুন করে ফেলার আগে বহুবার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে কেউ সেটা বুঝতে পারে না।

প্রিয় দেশবাসী গত ৩ মাস থেকে আমার ঘরে খাবার এর কষ্ট আমার বউ অনেক কষ্টে খাবার যোগাড় করতেছে। আমার মৃত্যুর পর আমার বউ ছেলে মেয়ের পাশে থাকবেন ওদের থাকার মতন জায়গাটাও আমি রেখে যেতে পারলাম না। কথা গুলান লিখতে লিখতে অনেক কাঁদলাম সবাইকে অনেক মনে পড়ছে। আর থাকতে পারলাম না চলে যাচ্ছি। ক্ষমা করে দিয়েন ক্ষমা করে দিও আল্লাহ।

প্রিয় দেশবাসী আমার স্ত্রী, ছেলে/মেয়ের জন্য কিছু করে যেতে পারলাম না। তবে আমি বেঁচে থাকলে আরো ঋণ বেড়ে যাবে তাই চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই। যদি সম্ভব হয় আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিবেন আপনারা। আর এই হতভাগা ভাইটাকে ক্ষমা করে দিবেন।

Advertisement