Homeসব খবরজেলার খবরদুঃসময়ে পেঁপে চাষ করে জীবনে বিপ্লব ঘটান সুমন

দুঃসময়ে পেঁপে চাষ করে জীবনে বিপ্লব ঘটান সুমন

পেঁপে বিপ্লবী হচ্ছেন, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে সুমন। তিনি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের বায়লাখালি গ্রামের প্রবাসী। চাকরির সুবাদে ২২টিরও বেশি দেশে ঘুরেছেন। কৃষক পরিবারে জন্ম, তাই কৃষির প্রতি ঝোঁক সেই ছোট বয়সেই। হৃদয়ের সেই টানে সুদুর আফ্রিকায় গিয়েও পেঁপে চাষবাদ শিখেছিলেন। কিন্তু ভাবেননি, সেই পেঁপেই তার দুঃসময়ে এভাবে পাশে দাঁড়াবে।

রীতিমতো তার জীবনে পেঁপে এমন বিপ্লব ঘটাবে। তিনিও দেশব্যাপী পেঁপের বিপ্লব ঘটানোর কাজে হাত দিয়েছেন। যদিও পেঁপে চাষের শুরুটায় ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন তিনি। ভাবছেন, বিদেশি প্রশিক্ষণের পর কেন এমন হলো? প্রশিক্ষণ নয়, সমস্যা ছিল পেঁপের বীজ নিয়ে। বীজ কিনে নিজে প্রতারিত হয়েছিলেন।

বাড়ির পাশেই ১০ শতাংশ জমি। আর নগদ পুঁজি বলতে স্ত্রী গলার হার বন্দক রেখে ৬৬ হাজার টাকা। মাত্র দুই মাসে পেঁপে চারা বিক্রি করে আয় ৬ লাখ টাকা, তাতেই স্বনির্ভর! এখানেই শেষ নয়। নার্সারি লাগোয়া প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে এক হাজারটি পেঁপে গাছ। ইতোমধ্যেই ৫শ মণ পেঁপে বিক্রি করেছেন। সমপরিমাণ পেঁপে এখনো ঝুলছে গাছে। প্রতিটা গাছে প্রায় ৪-৫ মণ পেঁপে ধরে। আছে পুকুর ভরা মাছ। আর ক্ষেত বোঝাই সবজি। সবকিছুর নেপথ্যের নায়ক এই ‘পেঁপে’।

তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কৃষকদের প্রতারিত হতে দেবেন না। কৃষকদের প্রতারণা থেকে বাঁচাতে তিনি নিজেই উন্নত জাতের পেঁপে চারা উৎপাদন করেছিলেন। শুধু চারা বিক্রি করে গেল বছর ৬ লাখ টাকা আয় করেছেন। তাতেই স্বনির্ভর! কৃষকদের শুধু পেঁপে চারা দিচ্ছেন না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফ্রিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। দেশের আনাচা কানাচের চাষিরা যারা তার চারা নিচ্ছেন, তাদের অনলাইনের মাধ্যমে বিনামূল্যে সার্বাক্ষণিক পরামর্শ দিচ্ছেন। শিক্ষা আর ধর্মীও প্রতিষ্ঠানের ফাঁকা আঙিনায় পেঁপে রোপণ করছেন নিজ উদ্যোগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চাষাবাদ শেখাচ্ছেন হাতে কলমে।

গাছপ্রতি লাভ চার হাজার টাকা

পেঁপে চাষে ঝক্কি-ঝামেলা নেই। খরচও বড়জোর গাছ প্রতি ৯০ টাকা। প্রতিটা গাছে প্রায় ৪-৫ মণ পেঁপে ধরে। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চাষাবাদ করলে ফলন বিক্রিতে ভালো টাকা পাওয়া যায়। সে হিসেবে একটি গাছের পেঁপে বিক্রিতে ঘরে আসে প্রায় চার হাজার টাকা। এ তো গেল কাঁচা পেঁপে। আর পাকলে? লাভের অঙ্কটা পাঁচ গুণ হয়ে যায়। এমনটাই দাবি আবু বকরের।

আবু বকরের এই বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের চারদিকে। চিরাচরিত ধান-গম চাষে লাভ কম। অথচ খাটনি বেশি। কিন্তু কম পরিশ্রমে, অল্প বিনিয়োগে পেঁপে চাষে লাভ হচ্ছে কয়েকগুণ। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চাষিরা পেঁপে চাষমুখী হচ্ছেন। উন্নত প্রযুক্তিতে পেঁপে চাষের উৎসাহ প্রকাশ করে দেশের অন্তত শতাধিক চাষি চারা নিতে তার কাছে নাম লিখিয়েছেন।

আবু বকর বলেন, আসছে মৌসুমে এক লক্ষ চারা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। ইতেমধ্যেই অনলাইনে ৮০ হাজার চারা বিক্রির অর্ডার পেয়েছি। নার্সরিতে পেঁপের চারা তৈরি করা হচ্ছে। আগামী মাস দেড়েকের মধ্যে চারার পাশাপাশি ওই চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তার কাছে শাহী, কাশ্মিরি আর টপ লেডি জাতের পেঁপের বীজ আছে। নার্সারিতে সেই বীজ দিয়ে চারা তৈরির কাজ খুব তাড়াতড়ি শুরু হচ্ছে।

তিনটি জাতের পেঁপেগুলো বেশ বড়। ফলের রং লাল-সবুজ। এক একটি ফলের ওজন দুই থেকে চার কেজি হয়। এ জাতের পেঁপে পুরু, গাঢ় লাল, স্বাদেও বেশ মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত। গাছের উচ্চতা ৬০-৮০ সেন্টিমিটার হলে চার মাসের মধ্যে ফল ধরা শুরু হয়। প্রতিটি গাছে ১০০টির বেশি ফল হয়। পাকা অবস্থায় সহজে নষ্ট হয় না বলে দূর-দূরান্তে বাজারজাত করা যায়। এই জাতের পেঁপের রোগ সহ্য করারও ক্ষমতা আছে।

আবু বকরের সংগ্রামী জীবন

১৯৫৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বায়লাখালীতে আবু বকরের জন্ম। চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বায়লাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়েছেন। সংসারের অভাব অনটনের কারণে ১৯৭৭ সালে নবম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে তিনি রেলওয়েতে চাকরি নেন। প্রায় চার বছর রেলের প্রজেক্টে চাকুরি করেন। ১৯৮১ সালের শেষ দিকে তিনি লেবাননের বৌরুতে যান। পরে সিরিয়া, প্যালেস্টাই ঘুরে ১৭ মাস পর দেশ ফিরেন।

আবার শুরু হয় বেকার জীবন। ঢাকার ফকিরারপুল এলাকায় মাথা গোজার ঠাই হয়। রং এর কাজ, দিনমজু করে জীবন চলছিল। এমনকি রক্ত বিক্রি করে পেটের খাবার যুগিয়ে ছিলেন। এভাবে দুটি বছর কেটে যায়। ১৯৮৬ সালের ঘটনা। একদিন সিঙ্গরা কিনে খাচ্ছিলেন। কাগজে বিদেশের যাত্রার একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায়। কুয়েতের যাত্রার সেই বিজ্ঞাপন দেখে আবু বকর ইন্টারভিউ দেন। সেখানে তিনি পেইন্টার হিসেবে কাজ করতেন। কাজের তাগিদে তিনি অন্তত ২২টির বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি হুন্দাই কম্পানির কনস্টাকশনের চাকরি ছেড়ে দেন। পরের বছর সাউথ আফ্রিকায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে ব্যবসা করেছেন। এমনকি তিনি ওই দেশে নাগরিকত্বও পেয়েছেন। আফ্রিকার মালাও পেঁপের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি হাতে কলমে পেঁপের চাষাবাদ শিখেছেন।

২০১৫ সালে দেশের টানে ফিরে আসেন। ঢাকায় ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ডাকাতির ফলে ব্যবসায় ধ্বস নামে। এরই মধ্যে তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমে কিডনীর সমস্যা দেখা দেয়। স্ত্রীর রোগে পেছনে তার নগদ যা উপার্যন ছিল, তা শেষ হয়ে যায়। ২০২০ সালে অর্থনৈতিকভাবে সংকটের মুখে পড়েন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তাকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। পরের বছর ১৫ নভেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান স্ত্রী।

শুরু হয় নতুন সংগ্রাম

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একাকি হয়ে পড়েন আবু বকর। একদিকে অর্থসংকট, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য উচ্চ সুদে নেয়া ঋণ পরিশোধের চাপ। অপর দিকে বেকারত্ব। স্ত্রীর রেখে যাওয়া গলার চেইন বন্ধক রেখে পেঁপে চাষ শুরু করেন। বাজার থেকে পেঁপের ঝকঝকে ছবি সম্বলিত প্যাকেটজাত বীজ কিনে বাড়ি নিয়ে আসেন। তা থেকে চারা করে লাগিয়ে লাভের অপেক্ষায় ছিলেন। চারা থেকে বড় গাছ হয়েছিলো ঠিকই, কিন্ত গাছে তেমন পেঁপের ফলন আসেনি। তাই পুরো টাকাই জলে। যে জলে টাকা গেলে সেই জলেই আবার নতুন করে ব্যবসার উদ্যোগ নেন।

সেজা কথায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিলেন আবু বকর। স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজের জমিতে পুকুর কাটেন। ধার করেন আরো ৮০ হাজার। প্রথমবার মাছ চাষে কিছুটা লাভের মুখ দেখেন। কিন্তু পেঁপে চাষের স্বপ্ন তাকে তাড়া করে ফিরছিল। ২০২১ সালের প্রথম দিকে উন্নত জাতের পেঁপে চারার খোঁজে তিনি এক নাগারে মাস খানেক বিভিন্নস্থানে ঘুরেছেন। শেষমেষ সাভারে উন্নত জাতের বীজ খুজে পান। মাত্র ৩০০ গ্রাম বীজ সোয়া লাখ টাকায় কিনে আনেন। সেই বীজ বিক্রি করে লাভ করেছেন ৬ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এলাকার বেকার ও শিক্ষার্থীদের পেঁপে চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজ করছি। একজন শিক্ষার্থী যদি লেখা পড়ার পাশাপাশি মাত্র ২৫টি পেঁপে গাছ লাগান। তা থেকে বছরে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এ ধরণের উদ্যোক্তা থাকলে আমি নিজে সময় ও শ্রম দিয়ে সফলতা অর্জনে সহযোগিতা করব। তবে বাগান করার আগে অবশ্যই জাত নির্বাচন ও সঠিক জাতের চারা রোপণ করে পরিচর্যা করলে সফলতা আসবেই।

আবু বকর আরো বলেন, ক্ষেতের পেঁপে থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। সেই বীজ সাভারে প্রক্রিয়াজত করন শেষে নার্সারিতে রোপণ করা হয়। রোপিত বীজ থেকে এক মাসের মধ্যে বিক্রিযোগ্য চারা তৈরি করা হয়। পাকা পেঁপের প্রতিটি থেকে ১০-১৫টি বীজ সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেই পাকা পেঁপে স্থানীয়দের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যেই ১০ মণ পাকা পেঁপে স্থানীয়দের মাছে দেওয়া হয়েছে। আরো ৫০ মণ পেঁপ দেওয়া হবে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার শাহ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, আবু বককর সিদ্দিক কর্মঠ মানুষ। তিনি বরিশালে পেঁপে চাষে চমক দেখিয়েছেন। কৃষকদের প্রতারণা থেকে বাঁচাতে তিনি নিজেই এখন উন্নত জাতের পেঁপে চারা উৎপাদন করছেন। সেই চারা নিজেই বিক্রি করছেন।

Advertisement