Homeসব খবরজেলার খবরজনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘বারোমাসি তরমুজ’, বিঘায় ফলন ৮ টন!

জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘বারোমাসি তরমুজ’, বিঘায় ফলন ৮ টন!

তরমুজ সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে ওঠে। এটাই তরমুজের প্রধান মৌসুম। কিন্তু সম্প্রতি এ দেশের বাজারে এ সময় ছাড়া অন্য সময়েও তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তরমুজ বেশি পাওয়া যায়। এ তরমুজকে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘বারোমাসি তরমুজ’। এক বিঘায় এ জাতের তরমুজের ফলন হয় প্রায় ৬ থেকে ৮ টন।

ছোট, লম্বাটে, ডিম্বাকার, কালো খোসা, ভেতরে টকটকে লাল শাঁসের তরমুজগুলো অসময়ে ওঠার কারণে বাজারে চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। কোনো স্থানে হলুদ রঙের খোসার অমৌসুমী তরমুজেরও চাষ হচ্ছে। দিন দিন অমৌসুমে তরমুজ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। হবিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, ভোলা প্রভৃতি জেলায় কিছু কৃষক ইতোমধ্যে এই বারোমাসি তরমুজ চাষ করে বিঘাপ্রতি প্রায় দেড় লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন।

জাত: ছোট আকারের বারোমাসি তরমুজের বেশ কয়েকটি জাতের বীজ এ দেশে এখন পাওয়া যাচ্ছে। এসব জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্লাক বেবী, ব্লাক প্রিন্স, ব্লাক বক্স, জেসমিন ১, জেসমিন ২, জেসমিন ৩ ইত্যাদি। এসব জাত বছরের যে কোনো সময় চাষ করা যায়।

চারা রোপণ: মধ্য মার্চ থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ জাতের তরমুজের চারা লাগানো যায়। বিঘায় মাত্র ৫০ গ্রাম বীজ লাগে। বিঘায় ১৪০০টি চারা লাগে। জমি তৈরির আগেই পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করে নিতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে শতকরা ১০ ভাগ চারা বেশি উৎপাদন করতে হবে।

চারা তৈরি: চারা উৎপাদনের জন্য সন্ধ্যাবেলায় ৪-৬ ঘণ্টা বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পানি ঝরিয়ে বীজ শুকিয়ে সুতি কাপড়ের মধ্যে রেখে ভাঁজ করে চটের বস্তায় তা আবার ভাঁজ করে মুড়িয়ে রাখতে হবে। বীজসহ চটের বস্তা ৩০-৪৫ ঘণ্টা রোদে জাগ দিয়ে রাখতে হবে। চটের বস্তায় পানি ছিটিয়ে মাঝে মাঝে তা ভিজিয়ে দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে চটের বস্তায় রাখা বীজ গজিয়ে যাবে। পলিব্যাগ বা প্লাস্টিকের কাপ-ট্রে তে চারা তৈরি করা ভালো। তবে এখন নানা সুবিধা ও কম খরচের কারণে অনেকেই প্লাস্টিকের ট্রে ব্যবহার করছেন। একটি ট্রে-তে ১০০টি চারা তৈরি করা যায়। এই ট্রের সুবিধা হলো, যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে স্থানান্তর করা যায়, বৃষ্টি থেকে সহজে রক্ষা করা যায় ও বারবার ব্যবহার করা যায়।

গজানো বীজ পলিব্যাগে ফেলার জন্য পলিব্যাগে গোবর সার মেশানো মাটি ভরে রাখতে হবে। মাটিভরা পলিব্যাগগুলো রোদপড়া কোনো জায়গা পরিষ্কার ও সমতল করে সেখানে ১ মিটার চওড়া করে জায়গা নিয়ে চারপাশ বাঁশের চটা দিয়ে ঘিরে বীজতলার জন্য বেড তৈরি করতে হবে। চারপাশে চারটি বাঁশের ছোট খুঁটি পুঁতে ও মাঝে মাঝে আরও কয়েকটি খুঁটি পুঁতে তার সাথে আড়ার মতো বাঁশের চটা বেঁধে এই বেড তৈরি করা যায়। বেডের চারপাশে চটার উচ্চতা মাটি থেকে ৪-৬ ইঞ্চি বা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হতে পারে। এসব ঝামেলা না করে শুধু চারপাশে চার টুকরো বাঁশ দিয়ে ঘিরেও পলিব্যাগের ঠেকনা দেয়ার কাজ বা বেড তৈরি করা যেতে পারে।

গজানো বীজ চট থেকে বের করে একটা একটা করে এক একটি পলিব্যাগের মাটিতে অল্প গভীরে বপন করতে হবে। বপনের আগে প্রতিটি পলিব্যাগের মাঝখানে একটা কাঠি দিয়ে সামান্য গর্ত করে রাখতে হবে। পলিব্যাগে বীজ বপনের আগে গজানো বীজের সাথে সামান্য শুকনো ঝুরঝুরে মাটি মিশিয়ে নিলে বীজ বপনে সুবিধা হবে।

অংকুর বের হওয়া মুখ নিচের দিকে দিয়ে মাটিতে বীজ বপন করতে হবে। তারপর তা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পলিব্যাগে বীজ বপন শেষ হলে ওপর থেকে হালকা করে ঝাঝরি দিয়ে পানি ছিটাতে হবে। ভারী বৃষ্টি যাতে চারার ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য বীজতলা বা বেডের ওপরে বাঁশের চটা দিয়ে নৌকার ছৈয়ের মতো করে পলিথিনের ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি বা কড়া রোদ থেকে এই ছাউনি চারাকে রক্ষা করবে।

জমি ও বেড তৈরি: জমিতে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে। চারপাশের আইল থেকে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার চওড়া করে লম্বা বেড করতে হবে। জোড়া সারি পদ্ধতিতে বেড তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতিতে প্রথমে ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া একটা বেড করতে হবে, তারপর ২.৫ মিটার জায়গা খালি রাখতে হবে। এরপর আবার ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া আর একটি বেড করতে হবে। এভাবে পাশাপাশি দুটো জোড়া বেড তৈরি হবে যার মাঝে ৬০ সেন্টিমিটার খালি থাকবে, যা সেচনালা ও পরিচর্যার চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হবে। আড়াই মিটার ফাঁকা জায়গায় তৈরি হবে মাচা। দুই বেডের মাঝের ফাঁকা জায়গার মাটি তুলে পাশের বেডে তুলে দিয়ে বেড উঁচু করতে হবে। কেউ কেউ এখন নিচু ধানের জমিতেও বারোমাসি তরমুজের চাষ করে এখন লাভবান হচ্ছেন।

সা’র প্রয়োগ: বারোমাসি তরমুজ চাষের জন্য ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচো সার ভালো হবে। বিঘাপ্রতি সার লাগবে- ভার্মিকম্পোস্ট ২০০ কেজি, ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি ৪০ কেজি, এমওপি ৪০ কেজি, জিপসাম ২০ কেজি, জিংক সালফেট ১ কেজি ও বোরণ সার ১.৫ কেজি। সব সার বেড তৈরির সময় বেডের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

পলিথিন মালচিং: বারোমাসি তরমুজ চাষের জন্য বেড ঢাকতে কালো রঙের পলিথিন শিট দিয়ে মালচিং করতে হয়। এক বিঘা জমির জন্য ১১ কেজি ওজনের একটি পলিথিন রোল দরকার হয়। পলিথিন রোল ৩ ফুট বা ১ মিটার চওড়া হলে চলে। মালচিং শিট বা পলিথিন বিছানোর জন্য বিশেষ দক্ষতার দরকার হয়। বেডের এক পাশ থেকে মালচিং শিট বিছানো শুরু করতে হবে। রোলের মাঝে একটা চিকন বাঁশ বা পাইপ ঢুকিয়ে নিলে রোল টানতে সুবিধা হয়।

মালচিং শিট বিছাতে ৩-৪ জন লোক হলে ভালো হয়। দু’জন রোল টানবে, এক বা দু’জন শিট বিছানোর পর বেডের দুইপাশ থেকে মাটি তুলে পলিথিনের পাশটা মাটিচাপা দিয়ে বেডের সাথে চেপে দেবে। মালচিং শিট যে প্রান্ত থেকে বিছানো শুরু করতে হবে সে প্রান্তে শিটের ধারটা বেড থেকে কিছুটা বাইরে বের করে মাটিচাপা দিয়ে আটকে দিতে হবে। টানার সুবিধার্থে সেই প্রান্ত দুটো বাঁশের খুঁটার সাখে বেঁধেও দেয়া যেতে পারে। মাটিচাপা দেয়া ও বেডে পলিথিন শিট বিছানোর পর খুঁটা তুলে ফেলা যেতে পারে। মালচিং শিট স্থাপনের পর জমি সেচ দিয়ে ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হবে।

চারা রোপণ: সেচ দেয়ার ৭-৮ দিন পর জমিতে ‘জো’ অবস্থা এলে চারা রোপণের কাজ শুরু করতে হবে। চারা রোপণের আগে নির্দিষ্ট দূরত্বে বেড বা পলিথিন মালচিং শিটের মাঝখান বরাবর ১০ সেন্টিমিটার বা ৪ ইঞ্চি ব্যাসের গোলাকার ছিদ্র করতে হবে। সহজ ও কম সময়ে, কম শ্রমে এ কাজ করতে চাইলে শক্ত ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা এক টুকরো ৪ ইঞ্চি ডায়ার পিভিসি পাইপ দিয়ে এ কাজ করা যেতে পারে।

এই পাইপের টুকরা নির্দিষ্ট স্থানে চেপে ধরে মোচড় দিলেই পলিথিন গোল করে কাটা হয়ে যাবে। কাটা ফাঁকা স্থানের মাটিতে চারা লাগানোর জন্য ছোট্ট গর্ত তৈরি করতে হবে। একটি গর্ত থেকে আর একটি গর্তের দূরত্ব হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা ১৮ ইঞ্চি। কাটা পলিথিনের টুকরা জমি থেকে কুড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, জমির ভেতরে রাখা যাবে না।

জমিতে ৫-৭ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের আগে দেখতে হবে পলিব্যাগের মাটিতে রস আছে কিনা। না থাকলে মাটি চারা রোপণের কিছুক্ষণ আগে হালকা করে ভিজিয়ে দিতে হবে। ব্লেড দিয়ে পলিব্যাগ কেটে বা পলিব্যাগের নিচে টিপ দিয়ে চেপে পলিব্যাগ থেকে চারা বের করা যায়। চারা রোপণের পর চারার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে হালকা সেচ দিতে হবে। বিকেলে চারা লাগানো ভালো।

মাচা তৈরি: দুই বেডের মাঝের ফাঁকা জায়গায় বাঁশ ও নাইলন রশি বা জিআই তার ব্যবহার করে মাচা তৈরি করে দিতে হবে। দোচালা ঘরের চাল বা নৌকার ছৈয়ের মতো মাচা তৈরি করা যায়। এতে দুইপাশের বেড থেকে গাছ উঠতে সুবিধা হয়। প্রথমে বাঁশের কাঠামো তৈরি করে তার ওপর ২০ সেন্টিমিটার বা ৮ ইঞ্চি দূরে দূরে তার বা রশি লম্বা করে টানিয়ে ফ্রেমগুলোর ওপর টেনে দিতে হবে। এরপর নাইলনের নেট বিছিয়ে দিতে হবে।

কুশিছাঁটা: মোট তিনবার কুশি ছাঁটতে হবে। প্রথমবার ছাঁটতে হবে মাচায় চারা তুলে দেয়ার সময়। মূল গাছের সাথে দুটি কুশি রেখে বাকিগুলো গোড়া থেকে ছেঁটে দিতে হবে। দ্বিতীয়বার ছাঁটতে হবে প্রথমবার কুশি ছাঁটার ৫-৭ দিন পর। এ সময় মাচায় নেটের নিচে ঝুলে পড়া কুশি ছেঁটে দিতে হবে। এর ৫-৭ দিন পর একইভাবে নেটের নিচে ঝুলে পড়া কুশিগুলো ছেঁটে দিতে হবে।

বালাই ব্যবস্থাপনা: তরমুজ গাছে বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়। এর মধ্যে অ্যানথ্রাকনোজ বা শুকনো পচা, ঢলে পড়া, আঠা ঝরা ইত্যাদি প্রধান ক্ষতিকর রোগ। এ ছাড়া ফলের মাছি, লাল মাকড়, সাদা মাছি, থ্রিপস, রেড পাম্পকিন বিটিল, এপিলাকনা বিটিল বা কাঁটালে পোকা, জাবপোকা ইত্যাদি পোকামাকড় আক্রমণ করে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে এসব রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যায়।

ফলে নেট বাঁধা: ফল বড় হওয়া শুরু হলে তা নেট দিয়ে বেঁধে না দিলে ছিঁড়ে পড়ে ক্ষতি হতে পারে। সেজন্য নেটের ব্যাগ বা নেট দিয়ে ফল বেঁধে দিতে হবে।

ফল তোলা: ফল ধারণের পর ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে ফল তোলার উপযুক্ত হয়ে যায়। এ সময় থেকে শুরু করে ৭০ দিন পর্যন্ত ফল তোলা যায়। এর পর গাছে ফল রাখা উচিত হবে না।-এগ্রিকেয়ার২৪

Advertisement