Homeসব খবরজেলার খবরগাছে না উঠেই নামানো যাচ্ছে খেজুরের রস!

গাছে না উঠেই নামানো যাচ্ছে খেজুরের রস!

পড়ন্ত বিকেলে কোমড়ে দড়ি বেঁধে হাসুয়া-বাটাল আর কলস নিয়ে খেজুর গাছে গাছির বেয়ে ওঠার ছবি কমবেশি সবার স্মৃতিপটেই গাঁথা। আগের দিন বিকেলে গাছে কলস ঝোলানো এবং পরদিন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে রসভর্তি সেই কলস নামানোর বিষয়টি চিরায়ত, সবারই জানা। শীত মানেই নতুন ধানের পিঠাপুলির সুগন্ধে মৌ মৌ করে কৃষাণীর হেঁশেলের চারপাশ। সাদা চালের আটা আর খেজুরের গুড় হয়ে ওঠে অন্যতম অনুষঙ্গ।

চিরাচরিত এই দৃশপট যদি হঠাৎই বদলে যায়? কি একটু ধাক্কা লাগল? কিন্তু ভাবুন তো! হ্যাঁ, অনেকটা এমন ঘটনাই ঘটেছে রাজশাহীর দুর্গাপুরে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে বুদ্ধি খাটিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহের এক অদ্ভুত পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন দুর্গাপুর উপজেলার বর্ধনপুরগ্রামের কৃষক সোহররাব আলী।

অভিনব এই কায়দায় খুব কম সময়েই নিচ থেকে ৭০-৮০টি গাছের খেজুরের রস মাটিতে হেঁটে বেড়িয়েই সংগ্রহ করা যাচ্ছে। তার এই উদ্ভাবিত পদ্ধতি নিয়ে এরই মধ্যে হইচই পড়ে গেছে পুরো গ্রামে। কনকনে শীতের ভোরে গাছের আগায় না উঠেই এখন নামানো যাচ্ছে খেজুরের রস!

স্থানীয়রা বলছেন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। সনাতনী জীবনপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে প্রবেশ করছেন আধুনিক জীবনে। দৈনন্দিন কাজকে সহজ থেকে আরও সহজতর করা হচ্ছে। আর এমন চিন্তা থেকেই কৃষক সোহররাব আলী গাছে না উঠেই খেজুরের রস নামানোর নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এ পদ্ধতিতে ভোরে কনকনে শীতের মধ্যে সেই শিশির ভেজা খেজুর গাছে আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠতে হবে না। নিচে দাঁড়িয়েই সংগ্রহ করা যাবে।

কীভাবে গাছে না উঠেই রস সংগ্রহ করছেন সোহরাব আলী!

একটি বোতলের ওপরের (চোঙা) অংশ কেটে প্লাস্টিকের সাদা ফিতা পাইপের মুখে বিশেষভাবে লাগিয়েছেন সোহরাব আলী। এর একটি মুখ খেজুর গাছের ওপরের অংশে এবং একটি মুখ গাছের নিচের অংশে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সোহরাব আলী মাটি থেকে অন্তত পাঁচ ফুট ওপরে গাছের দুইপাশে পেরেক পুঁতে চিকন তার দিয়ে সেই ঝুলিয়ে দেওয়া পাইপের নিচে কলস বেঁধে রাখছেন। এভাবে ওই পাইপের নিচে কলস পেতে রাখা হলেই ওপর থেকে এর ভেতর দিয়ে টপটপ করে নেমে আসছে খেজুরের রস। আগের দিন বিকেল থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত রসের কলস ভরছে এবং পরে তা অনায়াসেই নামানো যাচ্ছে।

সরেজমিনে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ৫নং ঝালুকা ইউনিয়নের বর্ধনপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় এই নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবক সোহরাব আলীর সঙ্গে।

সোহরাব জানান, তার বয়স যখন কেবল ১০-১২ বছর ঠিক তখন থেকেই তিনি খেজুরের গাছ লাগান। তারা তিন পুরুষ থেকে এই কাজ করেন। ওই গ্রামে তার বাবার দেড় শতাধিক খেজুরের গাছ রয়েছে। আর তার নিজেরও রয়েছে ৮০টি খেজুরের গাছ। তিনি রস সংগ্রহ করেন এবং সেই রস থেকে গুড় তৈরি করে বাজারেও বেচেন। আগে তিনিও সনাতনী পদ্ধতিতে খেজুরের রস সংগ্রহ করতেন। এজন্য লোক লাগতো, সময়ও বেশি লাগতো। পরে কাজটিকে আরও সহজ করার জন্য তিনি নিজে নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে এই অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

তিনি বললেন, আগের পদ্ধতিতে রস সংগ্রহে ভোর থেকে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগলেও এখন লাগে মাত্র আধা ঘণ্টা। বিশেষ এই পদ্ধতিতে খেজুরের রস সংগ্রহ করার কারণে গাছের ওপরে বাদুর বা অন্য প্রাণী বসতে পারে না। সাদা পাইপ ঝুলতে দেখে ভয়ে বাদুড় এই গাছেই বসে না। সে এটিকে ফাঁদ মনে করে। প্রতিদিন বিকেলে যখন গাছের উপরে উঠি তখন টিউবওয়েলের পানি দিয়ে পাইপ পরিষ্কার করে দিই। এতে রস আরও কাঁচের মতো স্বচ্ছ লাগে এবং বিশুদ্ধ থাকে।

এক প্রশ্নের জবাবে সোহরাব আলী বলেন, গাছের ওপরে কলস পাতা থাকলে তার মুখে বাদুড় অনায়াসেই বসতে পারে। এছাড়া অন্য পাখপাখালিও বসে। কিন্তু প্লাস্টিকের ফিতা পাইপের মুখ ছোট হওয়ায় এবং সেখানে বসার জায়গা না থাকায় বাদুড় বা অন্য পাখি বসতে পারে না। বাদুড়ের লালা, প্রস্রাব বা বিষ্ঠা থেকে নি’পাহ ভাই’রাস রসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়ানোর আশঙ্কা খুবই কম থাকে এই পদ্ধতিতে।

সোহরাবের এই নতুন পদ্ধতি গ্রামে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই নতুন পদ্ধতির কারণে প্রতিদিন কেবল একবার গাছে উঠলেই হয়। আর সনাতন পদ্ধতিতে গাছ কাটতে একবার এবং রস নামাতে একবার উঠতে হয়। মোট দুইবার গাছে উঠতে হয়।

Advertisement